এ কেমন প্রামাণ্যচিত্র উৎসব!

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে ‘১২তম লিবারেশন ডক্ ফেস্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে ৫ দিনব্যাপি আন্তর্জাতিক প্রামাণ্যচিত্র উৎসবের শেষ দিন ছিল সোমবার। ঘোষিত অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী এ দিন নির্বাচিত তথ্যচিত্র প্রদর্শনী শুরুর কথা ছিল বেলা ১১টায়। 

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মিলনায়তনে এ প্রদর্শনী দেখতে এই প্রতিবেদক সকাল পৌনে ১১টায় জাদুঘর প্রাঙ্গনে পৌছে দেখতে পান কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া সেখানে কেউ নেই। তবে জাদুঘর ভবনের দেওয়ালে বেমানানভাবে পেচিয়ে থাকা এ সংক্রান্ত তথ্য সম্বলিত কয়েকটি হ্যাংগিং ব্যানার উৎসবের দৈন্যতাকেই যেন জানান দিচ্ছিল।   

নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকে উৎসব সম্পর্কিত কোন আপডেট না পেয়ে জাদুঘর সচিবালয়ে গিয়ে ফারহাত নামে দায়িত্বরত একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি উৎসব সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। ফারহাত জানান, বেলা ১১টায় উৎসবের পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী তথ্যচিত্র প্রদর্শনী শুরু হবে।  

মিলনায়তনে গিয়ে দেখা যায়, ফাঁকা মিলনায়তনটিতে শুধুমাত্র একজন কর্মী প্রজেক্টরে প্রদর্শনের জন্য তথ্যচিত্র চালিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষার পর মৃন্ময় ব্যানার্জী নামে কলকাতা থেকে আসা একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা উপস্থিত হন সেখানে। তিনি জানালেন, তাঁর তথ্যচিত্র এই উৎসবে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে এবং ইমেইল ও ফোন করে তাকে উৎসবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

বেলা ১১টার কিছু পরে কোন দর্শনার্থীর উপস্থিতি এবং ঘোষণা ছাড়াই মৃন্ময় ব্যানার্জীর ‘বিপ্লবের ধ্বজা হাতে এনেছিল যাঁরা স্বাধীনতা’ শীর্ষক তথ্যচিত্রটির প্রদর্শন শুরু করেন ওই জাদুঘর কর্মী।

৪০ মিনিট দীর্ঘের এই তথ্যচিত্র প্রদর্শন শেষ হলে ফাঁকা মিলনায়তনে এক শুভানুধ্যায়ী নিয়ে নিজের নির্মাণ করা তথ্যচিত্র দেখতে আসা মৃন্ময় হতাশা ব্যক্ত করে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘কোন দর্শনার্থী যদি এই এটি না-ই দেখলো তবে তা আন্তর্জাতিক প্রামাণ্যচিত্র উৎসব নাম দিয়ে এখানে প্রদর্শনের কি গুরুত্ব থাকতে পারে! এমন উৎসবে আমন্ত্রণ জানানোরইবা কি প্রয়োজন ছিল?’

তরুণ এই নির্মাতা বলেন, ‘উৎসবে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে আয়োজকদের পক্ষ থেকে ইমেইল করা হয়, তাতে আমার টিমের জন্য ২টি পাশ ইস্যু করার কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে উপস্থিত হয়ে সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞেস করলে কেউই এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যয়ে এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছি। আগ্রহীরা যদি দেখতেই না পারলো তবে এ এধরণের আয়োজনে অংশগ্রহণ অর্থহীন।’

তিনি বলেন, ‘হয়তোবা আয়োজকরা এই উৎসব সম্পর্কে আগ্রহীদের কাছে তথ্য পৌছে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত অনুরাগীরা এই ধরণের আয়োজনে সব বাধা উপেক্ষা করেও ছুটে আসেন-অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তা দেখে এসেছি আমরা।’  

নির্মাতা মৃন্ময় ব্যানার্জীর তথ্যচিত্র দেখতে আসা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া জাদুঘর মিলনায়তনটি প্রদর্শনীর জন্য উপযোগি ছিল না বলে অভিযোগ করে বলেন, ‘মিলনায়তনে আধঘন্টার মতো বসে থেকে বুঝতে পারছি প্রদর্শনের আগে এটিতে স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতার কাজটিও করেননি জাদুঘর কর্মীরা। রীতিমতো দুর্গন্ধ পাচ্ছিলাম, এয়ারফ্রেশনার ব্যবহার করে একটি প্রেক্ষাগৃহকে যেভাবে প্রস্তুত করা হয়, এখানে তা করা হয়নি।’

এ রকম মিলনায়তনে এসে যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন বলেও মন্তব্য করেন এই বক্ষব্যাধি চিকিৎসক।  


মিলনায়তন থেকে বেরিয়েই জাদুঘর অভ্যন্তরে বিশ-পচিশজন স্বেচ্ছাসেবককে খোশগল্প করতে দেখা যায়। তাদের কেউই মিলনায়তনে কেন গেলেন না জানতে চাইলে-তারা কথা বলতে রাজি হননি। উৎসব সমন্বয়ে থাকা ফারহাতের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি দাবদাহের কারণে দর্শনার্থী না থাকার দায় এড়ান। তবে উৎসব সংশ্লিষ্ট জাদুঘর কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরাও কেন প্রদর্শনীতে থাকলেন না-এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দেননি তিনিও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাদুঘরের এক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘১২তম লিবারেশন ডক ফেস্ট বাংলাদেশ’ এর উদ্বোধন ও সমাপনী আয়োজনে কিছু অতিথি ও দর্শনার্থী ছাড়া এবারের আয়োজনে উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। গত ১৮ এপ্রিল জাদুঘর মিলনায়তনে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা নীলোৎপল মজুমদার এবং ভারতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা হাওবাম পবন কুমার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আসাদুজ্জামান নূর এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও উৎসব পরিচালক মফিদুল হক। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্য সচিব সারা যাকের।

২০০৬ সাল থেকে প্রামাণ্য চিত্র উৎসব শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এই উৎসবে বিশ্বের খ্যাতিমান নির্মাতাগণ তাদের তথ্যচিত্র নিয়ে অংশ নিয়ে এই উৎসবের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত জুরি বোর্ডের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেরা তথ্যচিত্র নির্মাতাদের পুরষ্কৃতও করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এবার এই উৎসব আয়োজনে সেই ঐতিহ্যিক পরম্পরা বজায় রাখতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর- এমন অভিযোগ তথ্যচিত্র নির্মাতাদের।  

Scroll to Top