এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ
ইসলাম মানবতার উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম। মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নামই ইসলাম। ইসলামে মানবতা সর্বাগ্রে শুধু নয়; বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে আষ্ঠেপৃষ্ঠে রয়েছে। রাসুলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন মানবতার শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। যা কোরআন ও হাদিসের পবিত্র হরফগুলো সাক্ষ্য দিয়ে যায় যুগ থেকে যুগ অবধি- নিরবধি। ইসলামের সুমহান বাণী ও রাসূলের গোটা জীবন বা সিরাহ মানবতায় পরিপূর্ণ।
রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজ্ঞতার যুগ বা the time of ignorance এ আরব ভূমিতে শুভাগমন করেন এবং সকল ধরণের অমানবিক কাজ যেমন- জীবন্ত কন্যা শিশু প্রোথিত, মদ-জুয়া ও হানাহানি রোধে সর্বাধিনায়ক এর ভূমিকা পালন করে তা রোধ করতে সক্ষম হন। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গোত্রীয় কলহের জেরে যুদ্ধ-বিগ্রহের ভয়াবহতা দমন করেন।
;
বিশেষভাবে পৃথীবির প্রথম সংবিধান মদিনার সনদ মানবাধিকারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যেখানে সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রকে সমানাধিকার দেয়া হয়। সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা, একক অপরাধী তার গোত্রের পরিচয় লাভ না করা, দুর্বল ও অসহায়কে সাহায্য, সকল অপরাধ নিষিদ্ধকরণ এবং অপরাধীকে ঘৃণার চোখে দেখে উপযুক্ত শাস্তির বিধান ইত্যাদি ধারাগুলো আজও মানবাধিকারের সার্বজনীন-সামাজিক-প্রামাণিক দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয়।
এছাড়াও আমরা যদি বিদায় হজ্বের ভাষণের দিকে লক্ষ্য করি সেখানেও রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের অন্তিম মুহুর্তেও তিনি মানবাধিকারের কথা বলে গিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সর্বদা আমানতের হেফাজত, রক্তের বদলে রক্তনীতি পরিহার, দাস-দাসীদের সাথে উত্তম ব্যবহার এমনকি নিজে পরিধেয় বস্ত্র ও নিজের আহার্য খাদ্য তাদেরও দেওয়ার নির্দেশ, অন্যায়ভাবে হত্যা ও ব্যভিচার না করার আহবান, বংশগত কৌলিন্য প্রথা বিলোপ এবং কোনো ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করার উদাত্তকণ্ঠে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এসকল নির্দেশনা বিশ্ব-বুকে মানবতার সুমহান ও সমুজ্জ্বল প্রদীপের মতো আলো বিকিয়ে পথ দেখাচ্ছে কোটি কোটি মুসলিমদের।
মানুষকে পৃথীবিতে আল্লাহর প্রতিনিধি রূপে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়াতে প্রত্যেক মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বাঁচার অধিকার রয়েছে। কোনোপ্রকার ভেদাভেদকে ইসলাম প্রাধান্য দেয়নি। এ ব্যাপারে কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো- “হে লোক সকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন। এবং আল্লাহকে ভয় কর- যার উছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক।” এ আয়াত দ্বারা সবাই এক আদম ও হাওয়া থেকে সৃষ্টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবাধিকার কোরআনের প্রতিটি অংশে খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ হরণে কোরআনে নিষেধ করা হয়েছে। এতিম এবং নারীদের প্রাপ্য সম্পদ তাদের বুঝিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। তাছাড়া কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা কিংবা দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি করা ঘোরতর অন্যায় কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন- “নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল।” (সুরা মায়েদা : ৩২)
তাছাড়া নারীদের উপর পুরুষকে এবং পুরুষদের উপরও তেমনিভাবে নারীদের ন্যায়সংগত অধিকার আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামে সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে গরিবের অধিকার খর্ব হওয়ায় সুদকে হারাম করা হয়েছে এবং যাকাতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুসলমানের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, যার হাত ও পা থেকে অপরাপর ব্যক্তি নিরাপদে থাকে সে-ই হলো প্রকৃত মুসলিম। কোনো রাষ্ট্রে যদি অন্যায় হয়ে থাকে তার যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিতকরণে বিচারিক কাজেও নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে বলেন- “তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে করবে।” (সুরা নিসা : ৫৮)
উপরোক্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়েও যাতে অধিকার ক্ষুণ্ণ না হয় তাতেও ইসলামের সতর্ক দৃষ্টি আছে। পরনিন্দা না করা, ক্ষমা প্রদর্শন, সদাচরণ, কু-ধারণা না করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে মজুরি প্রদান, নারীদের সাথে উত্তম আচরণ, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত, কারো মনে আঘাত না দেয়া ইত্যাদি। ব্যক্তিগত অধিকারসহ সামাজিক অধিকারের মধ্যে রয়েছে- সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মালিকানার অধিকার, সাম্যের অধিকার, চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার, লেখা, বলা ও প্রচার কার্যের অধিকার।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলাম নারী-পুরুষ সবার জন্য শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। হাদিস শরিফে রাসুলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘ইলম বা শিক্ষা গ্রহণ করা সব নারী ও পুরুষের ওপর ফরজ কর্তব্য।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। সব ধরনের মাদকদ্রব্য হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “হে বিশ্বাসী মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক তীর ঘৃণ্য বস্তু এগুলো শয়তানের কর্ম। সুতরাং, তোমরা তা বর্জন করো; যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সূরা মায়েদা: ৯০)
পাশ্চাত্য সভ্যতায় মানবাধিকারের ধারণাটি প্রথম জন্ম হয় ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সংযোজিত হয় The Bill of Rights. তৎপরবর্তীকাল থেকে মানবাধিকারের ধারণাটি সমগ্র পাশ্চাত্য দেশে বিকশিত হয় এবং ধীরে ধীরে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবাধিকার নিয়ে সরব হয় বহির্বিশ্ব। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ৩০টি ধারাসংবলিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ প্রণয়ন করেন। উক্ত ঘটনায় মৌলিক অধিকারে বাস্তবায়নে সাড়া দিতে বলা হয়। বিশ্ব ভূখণ্ডে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের নানাবিধ সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিটা রাষ্ট্র এর সংরক্ষণের জন্য নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে যাচ্ছে। কিন্তু তথাপিও আজ বিশ্ব ভূখণ্ডে মানবতা ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত।
বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার মোড়ল দাবিদার আমেরিকা- নিজেদেরকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিরল দাবি করলেও বাস্তবে দেখা যায় সেখানে ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অধিকার খর্ব হচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের সংবিধানে মানবাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোথাও মানবাধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ক্রমাগত ঘটেই চলছে। আজকের আধুনিক সভ্য যুগে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারকে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে রাসুলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজ্ঞতা ও অন্ধকার যুগে কলুষিত সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শতভাগ সফল হয়েছিলেন। সুতরাং, ইসলামের দিকনির্দেশিকা নীতিমালার আলোয় এবং সুযোগ্য ও দক্ষ শাসক দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র-ই কেবল হতে পারে মানবাধিকার রক্ষার অনন্য উপায়।