সকালের কুয়াশা ভেদ করে সোনালি রোদ যখন জানালার গ্রিলে এসে হেলান দেয়, পিঠের দিকে একটু উষ্ণতা ছড়ায়; বাসার উঠানে গুটিয়ে বসা কুকুরছানাটা একটু সোজা হয়ে বসে; আর রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে মায়ের হাতের গরম গরম হালুয়া-রুটির সুবাস – এ যেন বাংলার শীতের নিজস্ব কবিতা! কিন্তু এই শীতল সৌন্দর্যের মাঝেই লুকিয়ে থাকে সর্দি-কাশি, জ্বর, শুষ্ক ত্বক, অ্যালার্জি আর জয়েন্টের ব্যথার মতো অচেনা শত্রুরা। প্রকৃতির এই রূপান্তরের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলেই যেন অসুস্থতা নেমে আসে ঘরে। শীত মানেই কি শুধু কম্বলের নিচে গুটিশুটি মারা? না, মোটেই না! শীতকালে সুস্থ থাকার উপায় জানা থাকলে এই ঋতু হয়ে উঠতে পারে আনন্দ, উৎসব আর সুস্থতার অপূর্ব মেলবন্ধন। চলুন, জেনে নিই কিভাবে প্রাকৃতিক এই শীতলতাকে উপভোগ করার পাশাপাশি নিজেকে রাখতে পারি চনমনে ও রোগমুক্ত।
শীতকালে সুস্থ থাকার উপায়: শরীরের অভ্যন্তরীণ উনুন জ্বালিয়ে রাখুন
শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করা শীতকালীন সুস্থতার মূল ভিত্তি। এই দুটি জিনিসই অর্জন করা যায় মূলত সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে।
১. পুষ্টিকর ও উষ্ণ খাবারের জাদু
- ঘরোয়া উষ্ণ পানীয়: দিন শুরু হোক এক কাপ আদা-লেবু-মধুর চা, তুলসী পাতার ক্বাথ বা স্টিমিং গ্রিন টি দিয়ে। এই পানীয়গুলো গলা ব্যথা কমায়, সাইনাস পরিষ্কার করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। দুধ চা বা কফির বদলে হারবাল টি-কে প্রাধান্য দিন। গরম স্যুপ, বিশেষ করে মুরগির স্যুপ বা ডালের স্যুপ, ঠাণ্ডার বিরুদ্ধে দারুণ কাজ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঠাণ্ডা-কাশিতে তরল খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেয়।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার: আমলকী, কমলা লেবু, মাল্টা, পেয়ারা, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি – প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এই খাবারগুলো রাখুন। ভিটামিন সি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং শ্বেত রক্তকণিকার কার্যকারিতা বাড়ায়, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
- মধু ও আদার গুণ: কাঁচা আদা কুচি চিবোলে বা রান্নায় ব্যবহার করলে শরীর গরম থাকে এবং হজমশক্তি বাড়ে। মধু প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি। রাতে ঘুমানোর আগে এক চামচ মধু খাওয়া বা গরম পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া গলার খুশখুশে ভাব কমাতে সাহায্য করে।
- শক্তি জোগায় এমন খাবার: শীতকালে শরীরকে উষ্ণ রাখতে বেশি ক্যালোরি প্রয়োজন হয়। পুষ্টিকর শক্তির উৎস হিসেবে ডিম, বাদাম (কাঠবাদাম, আখরোট), খেজুর, মৌসুমি শাকসবজি (পালং, মেথি, সরষে শাক), মসুর ডাল, ছোলা, গুড় ও তিল/তিলের খাজা রাখুন খাদ্যতালিকায়। তবে অতিরিক্ত তেল-চর্বি বা ভাজাপোড়া এড়িয়ে চলুন। গুড় রক্ত পরিষ্কার করে এবং শরীর গরম রাখে – পৌষ পার্বণে তিলের খাজার প্রচলন এর জ্বলন্ত উদাহরণ!
- জিংক ও ভিটামিন ডি: জিংক (দুধ, বীজ, মাংস, ডালে থাকে) রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। সূর্যের আলো কম থাকায় শীতে ভিটামিন ডি-এর অভাব দেখা দিতে পারে। ডিমের কুসুম, ফর্টিফাইড দুধ, মাশরুম খান। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নিন। বাংলাদেশ পুষ্টি পরিষদ এর ওয়েবসাইটে দেশীয় খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
- হাইড্রেশন: শীতকালে তৃষ্ণা কম পায় বলে অনেকেই পর্যাপ্ত পানি পান করেন না। কিন্তু শুষ্ক বাতাস ত্বক ও শ্বাসনালী শুষ্ক করে, সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। দিনে ৮-১০ গ্লাস কুসুম গরম পানি পান করুন। ডাবের পানি, ফলের রসও (চিনি ছাড়া) ভালো বিকল্প।
২. পোশাক: স্মার্ট লেয়ারিংয়ে উষ্ণতার বিজ্ঞান
শীতকালে সুস্থ থাকার উপায় বলতে গেলে শুধু খাবার নয়, সঠিক পোশাক পরাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
- স্তরীভূত পোশাক (Layering): এটিই সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল। একসাথে মোটা একটি সোয়েটারের চেয়ে পাতলা কয়েকটি স্তর শরীরের তাপ ধরে রাখতে বেশি সাহায্য করে। ভেতরে সুতির জামা (ময়েশ্চার শোষণ করে), তার উপর উলের বা ফ্লীসের সোয়েটার, এবং সবচেয়ে বাইরে বাতাস ও পানি প্রতিরোধক জ্যাকেট পরুন। স্তর বাড়ানো-কমানো যায় তাপমাত্রা অনুযায়ী।
- প্রাকৃতিক আঁশের গুরুত্ব: উল, সুতি, সিল্ক – এগুলো শরীরের স্বাভাবিক তাপ ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। সিনথেটিক কাপড়ের চেয়ে এগুলো বেশি আরামদায়ক এবং ত্বকের জন্য ভালো। মোজা, টুপি, স্কার্ফ বা মাফলার ব্যবহার করতে ভুলবেন না। শরীরের প্রায় ৪০% তাপ হারিয়ে যায় মাথা থেকে! পায়ের তালু ঠাণ্ডা হলে সারা শরীরই ঠাণ্ডা লাগে বলে মনে হয় – তাই গরম মোজা পরুন।
- শিশু ও বয়স্কদের বিশেষ যত্ন: এদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম। অতিরিক্ত স্তরে জড়িয়ে রাখুন, তবে খুব টাইট কাপড় বা অতিরিক্ত স্তরে যেন শ্বাস নিতে কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। নবজাতককে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় (প্রায় ২৪-২৬°C) রাখার চেষ্টা করুন।
- ঘুমের সময় পোশাক: অতিরিক্ত ভারী কম্বল বা চাদরের চেয়ে পাতলা কম্বলের স্তর দিয়ে ঢেকে দিন। খুব মোটা পাজামা-জামার চেয়ে আরামদায়ক সুতির পোশাক পরা ভালো। ঘুমানোর আগে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হাত-পা ধোয়া এড়িয়ে চলুন।
শীতকালে সুস্থ থাকার উপায়: সক্রিয়তা ও বিশ্রামের সুষম সমন্বয়
শীত মানেই অলসতা নয়। শরীর সচল রাখা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া – দুটোই শীতকালীন সুস্থতার চাবিকাঠি।
৩. ব্যায়াম: শীতেও থাকুন ফুরফুরে
- সকালের রোদে ব্যায়াম: সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন, যখন সূর্যের আলো ও তাপ উপভোগ্য থাকে। রোদ ভিটামিন ডি সরবরাহ করবে আর ব্যায়াম শরীর গরম রাখবে ও এন্ডোরফিন নিঃসরণ করবে, যা মন ভালো রাখে। বাড়ির ছাদ, বারান্দা, পার্ক বা বাগান হতে পারে আদর্শ জায়গা।
- ঘরোয়া ব্যায়াম: প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বা বৃষ্টির দিনে ঘরেই ব্যায়াম করুন। জোয়িং, স্কিপিং, যোগব্যায়াম (সূর্য নমস্কার আদর্শ!), প্রাণায়াম, পুশ-আপ, স্কোয়াট, ডাম্বেল এক্সারসাইজ বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারেন। ইউটিউবে অসংখ্য গাইডেড ঘরোয়া ওয়ার্কআউট ভিডিও পাওয়া যায়। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম (যেমন: দ্রুত হাঁটা) টার্গেট রাখুন।
- শ্বাসের ব্যায়াম: প্রাণায়াম (অনুলোম-বিলোম, কপালভাতি) ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায় এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। সকালে খালি পেটে নিয়মিত অভ্যাস করুন।
- দৈনন্দিন কাজে সক্রিয়তা: বাড়ির কাজকর্ম (ঘর মোছা, ঝাড়ু দেওয়া, বাগান করা), হেঁটে বাজার করা বা সাইকেল চালানোও ভালো ব্যায়াম। দীর্ঘক্ষণ বসে না থেকে মাঝে মাঝে উঠে হাঁটাহাঁটি করুন।
৪. গুণগত ঘুম: শরীরের প্রাকৃতিক মেরামত কারখানা
- ঘুমের সময় ও পরিবেশ: রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন এবং ৭-৮ ঘন্টা ঘুমান। ঘুমানোর আগে মোবাইল, ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন (ব্লু লাইট ঘুমের হরমোন মেলাটোনিন নষ্ট করে)। ঘর অন্ধকার, শান্ত এবং ঠাণ্ডা (কিন্তু অতিরিক্ত ঠাণ্ডা নয়) রাখুন। আরামদায়ক গদি ও বালিশ ব্যবহার করুন।
- ঘুমানোর আগের রুটিন: হালকা গরম পানিতে গোসল, হালকা গরম দুধ (মধু সহ), বই পড়া বা হালকা স্ট্রেচিং ঘুমের জন্য সহায়ক। ভারী খাবার বা ক্যাফেইন ঘুমানোর কাছাকাছি সময়ে এড়িয়ে চলুন।
- কম্বল ও পোশাক: নরম, আরামদায়ক এবং পর্যাপ্ত উষ্ণ কম্বল ব্যবহার করুন। সুতির আরামদায়ক পোশাক পরুন। পা ঠাণ্ডা থাকলে মোজা পরে নিন।
শীতকালে সুস্থ থাকার উপায়: বাহ্যিক সুরক্ষা ও মানসিক সুস্থতা
শীতের আক্রমণ শুধু ভেতর থেকে নয়, বাইরে থেকেও আসে। ত্বক, শ্বাসযন্ত্র এবং মন – সবকিছুরই যত্ন নিতে হবে।
৫. ত্বকের বিশেষ যত্ন: শুষ্কতা ও ফাটল রোধ
শীতের শুষ্ক বাতাস ত্বকের আর্দ্রতা শুষে নেয়। ফলে চুলকানি, ফাটা, রুক্ষতা দেখা দেয়।
- ময়েশ্চারাইজিং: গোসলের পর (ভেজা শরীরেই) ত্বকে ময়েশ্চারাইজার লাগান। পেট্রোলিয়াম জেলি, গ্লিসারিন, শিয়া বাটার, কোকোয়া বাটার, নারিকেল তেল বা ভালো মানের বডি লোশন ব্যবহার করুন। দিনে ২-৩ বার লাগাতে হতে পারে, বিশেষ করে হাত, মুখ ও পায়ে। আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি (AAD) গোসলের পর ৩ মিনিটের মধ্যে ময়েশ্চারাইজার লাগানোর পরামর্শ দেয়।
- গোসলের অভ্যাস: খুব গরম পানিতে গোসল করবেন না। হালকা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন। গোসলের সময় ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখুন। কড়া সাবানের বদলে মাইল্ড, ময়েশ্চারাইজিং সোপ বা সিনডেট বার ব্যবহার করুন। গায়ে খুব জোরে ঘষবেন না।
- ঠোঁট ও হাত-পায়ের যত্ন: ঠোঁট ফাটা রোধে নিয়মিত লিপ বাম লাগান (ভ্যাসলিন দারুণ কাজ করে)। হাত ও পায়ের তালুতে বিশেষ মনোযোগ দিন। রাতে ঘুমানোর আগে গাঢ় ময়েশ্চারাইজার বা তেল মালিশ করে সুতি মোজা পরে নিন। হাত ধোয়ার পর অবশ্যই হ্যান্ড ক্রিম লাগান।
- সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা: মনে রাখবেন, শীতের রোদও ত্বকের ক্ষতি করে! বাইরে বের হলে SPF 30+ যুক্ত সানস্ক্রিন মুখ, হাত ও অন্যান্য খোলা জায়গায় ব্যবহার করুন।
৬. শ্বাসযন্ত্রের সুরক্ষা: ঠাণ্ডা-কাশি থেকে বাঁচার উপায়
শুষ্ক ও ঠাণ্ডা বাতাস শ্বাসনালীকে আক্রমণ করে, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সুযোগ দেয়।
- নাক-মুখ ঢাকা:: বাইরে বেরোলেই, বিশেষ করে ঘন কুয়াশা বা ধুলাবালিতে, মাস্ক পরুন বা মাফলার দিয়ে নাক-মুখ ঢাকুন। এটা বাতাসকে কিছুটা উষ্ণ ও আর্দ্র করে শ্বাস নিতে সাহায্য করে এবং জীবাণু ও দূষণ থেকে রক্ষা করে।
- লবণ পানির গার্গল: দিনে ২-৩ বার হালকা গরম লবণ পানি দিয়ে গার্গল করুন। এটা গলা ব্যথা কমায় এবং জীবাণু ধ্বংস করে।
- নাকের যত্ন: শুষ্ক নাকের ভেতরের অংশে পেট্রোলিয়াম জেলির হালকা প্রলেপ দিতে পারেন। নাক বন্ধ থাকলে স্টিম ইনহেলেশন নিন (গরম পানিতে ইউক্যালিপটাস তেলের কয়েক ফোঁটা দিয়ে)। নাক ঝাড়ার সময় এক নাক বন্ধ করে অন্যটি ঝাড়ুন, খুব জোরে নয়।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: সাবান পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন, বিশেষ করে বাইরে থেকে এসে, খাবার আগে ও নাক-মুখ স্পর্শ করার আগে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন। ঘরবাড়ি ধুলোমুক্ত রাখুন, নিয়মিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনিং করুন। ধূমপান ও ধোঁয়াযুক্ত পরিবেশ এড়িয়ে চলুন।
৭. মানসিক সুস্থতা: শীতের বিষণ্ণতা দূর করুন
দীর্ঘস্থায়ী ঠাণ্ডা, কম সূর্যালোক এবং বদ্ধ ঘরে থাকার কারণে অনেকেই শীতকালীন বিষণ্ণতা বা সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (SAD)-এর শিকার হন।
- প্রাকৃতিক আলোয় সময় কাটান: দিনের বেলা যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক আলোয় থাকার চেষ্টা করুন। জানালার পর্দা খুলে দিন, বারান্দায় বসে চা খান, দিনের আলোতে হাঁটুন। আলো মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নিঃসরণ বাড়ায়, যা মন ভালো রাখে।
- সামাজিক মেলামেশা: একাকিত্ব বিষণ্ণতা বাড়ায়। পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের সাথে সময় কাটান, ফোনে কথা বলুন, প্রিয়জনের সাথে গল্প করুন। উৎসবের সময়গুলো উপভোগ করুন।
- শখের চর্চা: বই পড়া, গান শোনা, গান গাওয়া, আঁকা, বাগান করা, রান্না করা – নিজের পছন্দের কাজে সময় দিন। এটি মানসিক চাপ কমায়।
- সাহায্য চাইতে দ্বিধা করবেন না: যদি নিজেকে অতিরিক্ত দুঃখিত, হতাশ, শক্তিহীন বা ঘুম ও খাবারের সমস্যায় ভুগতে দেখেন, দেরি না করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং অন্যান্য ক্লিনিকে পরামর্শ পাওয়া যায়।
এই শীতকাল, প্রকৃতির শীতল স্পর্শকে ভয় না পেয়ে, তাকে বরণ করে নিন প্রস্তুতির সাথে। শীতকালে সুস্থ থাকার উপায় শুধু কিছু নিয়মকানুন নয়, এটা হল এই ঋতুর সাথে আমাদের দেহ-মনের সামঞ্জস্য বিধানের এক সুন্দর শিল্প। উষ্ণ পানীয়র কাপে হাতের তালু গরম করার মজা, সকালের রোদে শরীর ভেজানোর আনন্দ, গরম গরম পিঠা-পুলির স্বাদ, আর প্রিয়জনের সাথে কম্বলের নিচে গল্পের মুহূর্ত – এই ছোট ছোট উষ্ণতাই তো শীতের সত্যিকারের সৌন্দর্য। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত সক্রিয়তা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, ত্বক ও শ্বাসের যত্ন এবং মানসিক সুস্থতার দিকে খেয়াল রেখে আমরা শুধু রোগই প্রতিরোধ করব না, এই শীতকে করে তুলতে পারব জীবনের এক অনন্য, সুস্থ ও সুখময় অধ্যায়। তাই আর দেরি নয়, আজ থেকেই এই সহজ টিপসগুলো মেনে চলুন, নিজেকে ও আপনার প্রিয়জনকে শীতের সুস্থ আনন্দে ভরিয়ে তুলুন!
জেনে রাখুন-
১. শীতকালে ঠাণ্ডা পানি খাওয়া কি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?
শীতকালে কুসুম গরম পানি খাওয়াই আদর্শ। ঠাণ্ডা পানি খেলে তাৎক্ষণিকভাবে গলা বা শ্বাসনালীতে জ্বালাপোড়া বা খুশখুশে ভাব হতে পারে, বিশেষ করে যাদের গলা বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। তবে সুস্থ ব্যক্তির জন্য মাঝে মধ্যে ঠাণ্ডা পানি খাওয়া ক্ষতিকর নয়, তবে কুসুম গরম পানি হজমে সহায়ক এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
২. শীতকালে ঘন ঘন গোসল করা কি উচিত?
প্রতিদিন গোসল করা ভালো, তবে খুব গরম পানি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ গোসল করা উচিত নয়। হালকা কুসুম গরম পানি দিয়ে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে ফেলুন এবং গোসলের পরপরই পুরো শরীরে ময়েশ্চারাইজার লাগান। খুব ঠাণ্ডা বা অসুস্থ থাকলে প্রতিদিন গোসল বাদ দিতে পারেন, তবে মুখ, হাত-পা ও প্রয়োজনীয় অংশ পরিষ্কার রাখুন।
৩. শীতকালে কোন ধরনের ফল বেশি খাওয়া ভালো?
শীতকালে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন কমলা, মাল্টা, পেয়ারা, আমলকী, আপেল, নাশপাতি, স্ট্রবেরি খাওয়া খুব উপকারী। এছাড়াও কলা, খেজুর, আঙুরও পুষ্টিগুণে ভরপুর। শুকনো ফল (কিসমিস, খেজুর, ডুমুর, অ্যাপ্রিকট)ও শক্তি ও পুষ্টি জোগায়। দেশীয় মৌসুমি ফলগুলোর দিকে নজর দিন।
৪. শিশুদের শীতকালে বিশেষ কী কী সতর্কতা নেয়া উচিত?
শিশুদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম। তাই তাদের পর্যাপ্ত উষ্ণ পোশাক পরাতে হবে (স্তরীভূত পদ্ধতিতে), বিশেষ করে মাথা, কান, হাত ও পা ঢেকে রাখতে হবে। গরম পানীয়, স্যুপ, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার দিন। ঠাণ্ডা পানি ও ঠাণ্ডা খাবার এড়িয়ে চলুন। ঠাণ্ডা জায়গায় খেলাধুলা সীমিত করুন। সর্দি-কাশি বা জ্বর দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। টিকা (ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া) সময়মতো দিতে ভুলবেন না।
৫. শীতকালে হাঁটু বা জয়েন্টে ব্যথা বেড়ে যায়, কী করব?
শীতকালে রক্তনালী সংকুচিত হয়, জয়েন্টে রক্তপ্রবাহ কমে যায় এবং পেশী শক্ত হতে পারে – ফলে ব্যথা বাড়ে। উষ্ণ পোশাক পরুন, বিশেষ করে ব্যথার জায়গাটা ভালো করে ঢাকুন। হালকা গরম সেক দিতে পারেন (গরম পানির বোতলে বা হট ব্যাগ)। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করুন (যেমন সাঁতার বা ওয়াটার অ্যারোবিক্স, যোগব্যায়াম) যাতে জয়েন্ট নমনীয় থাকে। ওজন যেন না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখুন। ব্যথা বেশি হলে ফিজিওথেরাপিস্ট বা অর্থোপেডিক সার্জনের পরামর্শ নিন।
৬. শীতকালে হার্টের রোগীদের বিশেষ কোন সতর্কতা নিতে হবে?
হ্যাঁ, শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। ঠাণ্ডা আবহাওয়া রক্তনালী সংকুচিত করে এবং রক্তচাপ বাড়াতে পারে। তাই হার্টের রোগীদের অবশ্যই গরম কাপড় পরিধান করে শরীর গরম রাখতে হবে, বিশেষ করে বাইরে বের হলে। খুব ভোরে বা সন্ধ্যায় ঠাণ্ডায় হাঁটাচলা এড়িয়ে চলুন। নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন, রক্তচাপ ও সুগার মনিটর করুন। ভারী কাজ, অতিরিক্ত পরিশ্রম বা হঠাৎ করে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা থেকে বিরত থাকুন। কোনো অসুবিধা মনে হলে দ্রুত ডাক্তারের শরনাপন্ন হোন।