সমাজ, সংস্কার ও পারিবারিক চাপে গড়ে ওঠছে সিদ্ধান্তহীন এক প্রজন্ম

সমাজ, সংস্কার ও পারিবারিক চাপে গড়ে ওঠছে সিদ্ধান্তহীন এক প্রজন্ম

“এই বিয়েটা আমি চাইনি। বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই হয়েছিল। এখন আমার জীবনের ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।” —এমনই করুণ বাস্তবতার কথা বলছিল কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগ এলাকার ১৭ বছরের এক কিশোরী। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করার পরও তাকে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। এখন সে গর্ভবতী—যেখানে তার নিজের কোনো মানসিক প্রস্তুতিই ছিল না।

সমাজ, সংস্কার ও পারিবারিক চাপে গড়ে ওঠছে সিদ্ধান্তহীন এক প্রজন্মসমাজ, সংস্কার ও পারিবারিক চাপে গড়ে ওঠছে সিদ্ধান্তহীন এক প্রজন্মএটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশে প্রতিদিন শত শত কিশোর-কিশোরী তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারে না। জন্ম, শিক্ষা, বিয়ে কিংবা সন্তান—অনেককিছুই ঘটে তাদের অজান্তে। রাইজিংবিডির করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের ১৫–২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ। অথচ এই বিপুল জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ নিজেদের জীবনের মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায় না। সমাজ, সংস্কার ও পারিবারিক চাপে তারা হয়ে পড়ে সিদ্ধান্তহীন এক প্রজন্ম।

এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য: “ন্যায্য ও সম্ভাবনাময় বিয়ে ও পছন্দের পরিবার গড়তে প্রয়োজন তারুণ্যের ক্ষমতায়ন”—প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তথ্যের অভাবে থমকে যায় ভবিষ্যৎ
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, দেশের ১৫–১৯ বছর বয়সী কিশোরী মায়েদের ৬০ শতাংশই আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার জানে না। অথচ এই বয়সেই তাদের অনেককে গর্ভধারণ করতে হচ্ছে—নিজের অজ্ঞতার ভারেই।

স্কুল-কলেজে যৌনশিক্ষা অনুপস্থিত, পরিবারে এই বিষয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ, আর সমাজের রক্ষণশীলতা তরুণদের তৈরি করছে এক ধরনের ভয়ভীতির আবরণে—যেখানে জ্ঞান, সিদ্ধান্ত কিংবা স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই।

মেয়েদের জীবনে বিয়ে মানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশে প্রতি চারজন কিশোরীর একজন এখনও ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে। যদিও আইনে বাল্যবিয়ে দণ্ডনীয়, বাস্তবে এর প্রতিকার নেই বললেই চলে। মেয়েদের মতামত না নিয়েই অনেক সময় বাবা-মায়েরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ফলে শিক্ষাজীবন, স্বপ্ন ও আত্মপরিচয়—সবই হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।

ছেলেরাও বন্দী বাস্তবতায়

এই বাস্তবতা শুধু নারীদের নয়, পুরুষদেরও স্পর্শ করছে। মাদারীপুরের কলেজপড়ুয়া জামিল হোসেন জয় জানান, “২১ বছর বয়সে পরিবারের চাপে বিয়ে করি। এরপর সংসারের চাপ সামলাতে গিয়ে পড়াশোনা বাদ দিতে হয়েছে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণদের উপকারভোগী হিসেবে না দেখে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদার করতে হবে। তাদের ক্ষমতায়ন না হলে উন্নয়নের স্বপ্ন শুধু কাগজেই থাকবে।

এজন্য প্রয়োজন বাস্তবমুখী উদ্যোগ—কিশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, যৌনতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক বাধ্যতামূলক শিক্ষাগোপনীয় হেল্পলাইন ও পরামর্শ কেন্দ্র, অনলাইন সচেতনতামূলক প্ল্যাটফর্ম, পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে তরুণদের প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি।

জাতীয় দিবসে উন্নয়নের বার্তা

১১ জুলাই আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হলেও, জাতীয় পর্যায়ে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৫-এর মূল অনুষ্ঠান হচ্ছে ১৪ জুলাই ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণবিষয়ক উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, “তরুণদের আমরা সিদ্ধান্ত নিতে দিই না, অথচ তাদের নিয়েই উন্নয়নের স্বপ্ন দেখি—এই দ্বৈততা বন্ধ করতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “পরিবার ও সমাজকে বুঝতে হবে—তরুণদের ভয় নয়, বরং তাদের মতামত ও সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিলেই গড়ে উঠবে শক্তিশালী সমাজ।”

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল রহমান বলেন, “বাল্যবিয়ে রোধে ধর্মীয় ও স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে পিতা-মাতাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তরুণদের নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “জাতির ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতেই। কিন্তু এই হাত যদি নিয়ন্ত্রণহীন, পরাধীন এবং অসচেতন থাকে, তবে জাতীয় উন্নয়নও অন্ধকারেই রয়ে যাবে। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৫ তাই কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয় এটি তরুণদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসম্মান ও সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকারে বিশ্বাস স্থাপনের বার্তা। তরুণদের ওপর বিশ্বাস রাখুন। তাদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিন। সিদ্ধান্ত নিতে শেখান। তবেই গড়ে উঠবে একটি আত্মনির্ভর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ।”

Scroll to Top