গত দুই দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে ‘ইরানের পারমাণবিক’ অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে রয়েছের। জাতিসংঘ আণবিক শক্তি সংস্থা ২০০৩ সালে যখন প্রকাশ করে, তেহরান গোপনে ১৮ বছর ধরে একটি পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে আসছে; যার মধ্যে রয়েছে একাধিক বৃহৎ ও অত্যাধুনিক পারমাণবিক স্থাপনা- তখন থেকেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কূটনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়।
এই বিস্ময়কর তথ্য ফাঁস হওয়ার পর, যা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত চুক্তির (এনপিটি) একজন স্বাক্ষরকারী হিসেবে ইরানের দায়িত্ব লঙ্ঘনের ইঙ্গিত, বিশ্ব কূটনীতির চাকা দ্রুত ঘুরতে শুরু করে।
পশ্চিমা শক্তিগুলোর পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের মতো তেহরানের পুরনো মিত্ররাও নিন্দা, নিষেধাজ্ঞা ও চাপ প্রয়োগের নানা পদক্ষেপে যুক্ত হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির সরকার দাবি করেছিল, এই পারমাণবিক কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই আবিষ্কারকে তাদের দীর্ঘদিনের সন্দেহের প্রমাণ হিসেবে দেখেছিল- তাদের বিশ্বাস ছিল, তেহরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জর্জ ডব্লিউ. বুশ, বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেন, এই চার মার্কিন প্রেসিডেন্টের শাসনামলে এক কেন্দ্রীয় ইস্যু হিসেবে আলোচনায় ছিল।
এই নেতারা ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলেও তাদের লক্ষ্য ছিল এক- ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে। কারণ, এমন একটি সম্ভাবনা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যকে আমূল বদলে দিতে পারে।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এতে ওই অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ ২০০২ সালে ‘অ্যাক্সিস অব ইভিল’ ভাষণে ইরানকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর তেহরানের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে জোরালো চাপ প্রয়োগ করেন।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার শাসনামলের দুই বছর ব্যয় করেন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানির সরকারগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তেহরানের সঙ্গে আলোচনায়। এর ফলস্বরূপ ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় ‘যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা’। এই চুক্তির আওতায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও সীমা আরোপের বিনিময়ে তেহরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা হয়।
প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ওই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় তেহরান চুক্তির শর্তগুলো উপেক্ষা করতে শুরু করে এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের হার বাড়িয়ে ৬০ শতাংশে নিয়ে যায়- যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ৪.৫ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশের অনেক কাছাকাছি।
ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। এরপর দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসা ট্রাম্প আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেয় এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমাবর্ষণ করে, যার লক্ষ্য ছিল সেগুলোকে অকার্যকর করে দেওয়া।
এই লেখার সময় পর্যন্ত এটা পরিষ্কার নয় যে, সেই লক্ষ্য কতটা সফল হয়েছে, কারণ হামলার ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির কোনো নিরপেক্ষ মূল্যায়ন এখনো পাওয়া যায়নি। এখন বিরোধ চললেও আসলে এই জটিলতার সূচনা হয়েছিল ওয়াশিংটন থেকেই, কারণ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই। সবকিছুর শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনহাওয়ারের একটি ভাষণ দিয়ে।
শান্তির জন্য পরমাণু
১৯৫৩ সালের ৮ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, পারমাণবিক প্রযুক্তি যখন সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তা মানবজাতির জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে ওঠে।
এই প্রযুক্তি তখন আর কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সম্পদ ছিল না- অন্যান্য দেশও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা অর্জন করছিল, যা বিস্তারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছিল।
আইজেনহাওয়ার বলেন, এই অস্ত্র কেবল সৈনিকদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। আমাদের উচিত এটি তাদের হাতে তুলে দেওয়া, যারা এর সামরিক আবরণ সরিয়ে শান্তির কাজে ব্যবহার করতে জানে।
তিনি জাতিসংঘের অধীনে একটি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন, যার কাজ হবে পারমাণবিক পদার্থকে মানবকল্যাণে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। এই শক্তিকে চিকিৎসা, কৃষি এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ প্রয়োজনে ব্যবহার করার পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, বিশ্বের যে অঞ্চলগুলো জ্বালানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে, সেখানে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করাই হবে আমাদের একটি বিশেষ লক্ষ্য।
ভাবনাটি ছিল এমন- যেসব শক্তিধর রাষ্ট্র পারমাণবিক পদার্থ উৎপাদনে সক্ষম, তারা তা জাতিসংঘের একটি সংস্থার হাতে তুলে দেবে। সংস্থাটি সেগুলো নিরাপদে সংরক্ষণ করবে এবং গবেষকদের হাতে তুলে দেবে, যাতে তারা এই শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।
আইজেনহাওয়ারের সেই ভাষণই আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা গঠনের বীজ বপন করে। পাশাপাশি এটি জন্ম দেয় ‘অ্যাটমস ফর পিস’ বা শান্তির জন্য পরমাণু নামক এক উদ্যোগের, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহায়তা করতে শিক্ষা ও প্রযুক্তি সরবরাহ করতে শুরু করে।
পারমাণবিক দৈত্যকে বোতল থেকে বের করে আনা
জাতিসংঘে দেওয়া সেই ভাষণের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অ্যাটমস এনার্জি অ্যাক্ট সংশোধন করে। এর ফলে অন্যান্য দেশকে পারমাণবিক প্রযুক্তি ও উপকরণ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়। শর্ত ছিল, এসব উপকরণ কোনোভাবেই অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে আইজেনহাওয়ার প্রশাসন আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনকে ‘মুক্ত বিশ্বের’ দেশগুলোর কাছে সীমিত পরিমাণ বিভাজনযোগ্য পদার্থ রপ্তানির অনুমতি দেয় এবং পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
পেন্টাগনের সাবেক প্রতিরোধনীতি পরিচালক পিটার আর. লাভয় আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন- এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লেখেন, ‘এই রপ্তানির উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব বজায় রাখা, সোভিয়েত প্রভাব হ্রাস করা এবং বিদেশি ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের উৎসে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।’
এই কর্মসূচির প্রথম উপকারভোগী ছিল ভারত। এরপর একে একে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসরায়েল, তুরস্ক, পাকিস্তান, পর্তুগাল, গ্রিস, স্পেন, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং ইরান- এই দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সহায়তা পেতে শুরু করে।
তেহরানের জন্য একটি চুল্লি
১৯৫৭ সালের ৫ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন ইরানে শাসন করছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। অ্যাটমস ফর পিস উদ্যোগের আওতায় এই চুক্তি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভিত্তি স্থাপন করে। ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে, ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরান ছিল একটি কৌশলগত সম্পদ।
উইলসন সেন্টার-এ ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে জোনা গ্লিক-আন্টারম্যান লেখেন, তৎকালীন সংরক্ষিত নথিপত্র অনুযায়ী, নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা ইরানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কৌশলের মূলভিত্তি হিসেবে দেখা হতো এবং অ্যাটমস ফর পিস কর্মসূচি ইরানকে পশ্চিমা জোটের প্রতি অনুগত রাখার একটি উপায় ছিল।
১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানকে একটি পাঁচ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি সরবরাহ করে, যার সঙ্গে দেওয়া হয় উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, যা চুল্লিটি চালাতে প্রয়োজন ছিল। তিন বছর পর, অর্থাৎ ১৯৭০ সালে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) অনুমোদন করে। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরান প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন বা উন্নয়নের চেষ্টা করবে না।
তবে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির মন থেকে সেই লক্ষ্য পুরোপুরি মুছে যায়নি।
২০১৩ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আকবর এতেমাদ, যিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক হিসেবে পরিচিত বলেন, শাহ তখন বলেছিলেন, যদি ইরান যথেষ্ট শক্তিশালী হয় এবং আমাদের আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তিনি আমাকে বলেছিলেন, যদি পরিস্থিতি বদলায়, তাহলে আমাদের পারমাণবিক পথে হাঁটতেই হবে। তার মনে সেই চিন্তা ছিল।
১৯৭৪ সালে গঠিত ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন এতেমাদ, এবং তিনিই দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির প্রাথমিক বিকাশের নেতৃত্ব দেন। সেই বছরই শাহ ঘোষণা দেন, আগামী দুই দশকে ইরানে ২৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে, যার প্রত্যেকটির উৎপাদনক্ষমতা হবে প্রায় ২৩ হাজার মেগাওয়াট। তিনি পুরো পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন চক্র গড়ে তোলার পরিকল্পনাও করেন। কিন্তু একটি বড় বাধা ছিল, ইরানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ পারমাণবিক প্রকৌশলী ও পদার্থবিজ্ঞানী ছিল না।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এক প্রবন্ধে আরিয়ানা রোবারি লেখেন, কারণ ইরানে পারমাণবিক প্রকৌশল ও পদার্থবিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত লোকের অভাব ছিল, তাই তেহরানের গবেষণা চুল্লিটি প্রায় এক দশক ধরে অচল অবস্থায় পড়ে ছিল, কারণ এটি চালানোর মতো দক্ষ জনবল ছিল না।