এক সময় ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এখন তারা একে অপরের বিরুদ্ধে “মিথ্যাবাদী” অভিযোগ এনে প্রকাশ্যে তীব্র লড়াইয়ে জড়িয়েছেন। এই ঘটনাটি তাদের সম্পর্কের কার্যকলাপ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব উন্মোচন করেছে।
ওয়াশিংটন ডিসি – ইলন মাস্ক ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচ্চপ্রোফাইল রাজনৈতিক মিত্রতা হঠাৎ ভেঙে গেছে, যেখানে উভয় পক্ষই প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে অসত্য বলার অভিযোগ তুলেছেন। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তাদের সম্পর্কের শুরু হয়েছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে। মাস্ক ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন এবং প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিলেন ট্রাম্পের প্রচারণা ও অন্যান্য রিপাবলিকানদের সহায়তায়। কিন্তু এখন সম্পর্কটি সামাজিক মাধ্যমে এক তিক্ত দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে।
মাস্কের হোয়াইট হাউজে ব্যতিক্রমী প্রবেশাধিকার, “ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি ”–এর নেতৃত্ব, প্রায় নিয়মিত ওভাল অফিসে যাতায়াত এবং লিঙ্কন বেডরুমে রাত্রিযাপন—সবকিছুই এই মিত্রতার ঘনিষ্ঠতা বোঝায়। তবে অনেকেই তাদের ব্যক্তিত্বগত বৈশিষ্ট্য ও আলোচনার প্রতি আসক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। উভয়েরই ‘স্পটলাইট’ ভাগাভাগি করতে অনীহা ছিল, যা শেষ পর্যন্ত এই তিক্ত বিচ্ছেদের মঞ্চ প্রস্তুত করে।
২০২৫ সালের ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজে একটি “উত্তপ্ত বৈঠকে” এই সম্পর্কের প্রথম ফাটল দেখা দেয়, যেখানে ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রকাশ্যে ইলন মাস্ককে “মিথ্যাবাদী” বলে অভিযুক্ত করেন। পরিবহনমন্ত্রী শন ডাফি মাস্কের বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রক কর্মীদের গণহারে ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে “প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ” প্রতিক্রিয়া জানান। ডাফি অভিযোগ করেন, মাস্ক এমন কর্মীদেরও ছাঁটাই করছেন, যাদের ছাঁটাই করা উচিত ছিল না। মাস্ক তা অস্বীকার করেন। ডাফি ট্রাম্পের কাছে একটি স্প্রেডশিট উপস্থাপন করেন, যেখানে মাস্কের ছাঁটাই-পরিসংখ্যান নিয়ে “মিথ্যা” বলার অভিযোগ তোলা হয়।
এরপর ভেটেরান্স অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি ডগ কলিন্স অভিযোগ করেন, মাস্কের ““ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি কাট”–এর কারণে ভিএ হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। মাস্ক তা অস্বীকার করলে কলিন্স কৌশলগতভাবে ছাঁটাইয়ের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ট্রাম্পও এতে সম্মতি জানান। সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিওও অভিযোগ তোলেন, যার জবাবে মাস্ক বলেন, “আমি কাউকেই বরখাস্ত করিনি,” ইঙ্গিত দেন রুবিও নিজেই নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সূত্র জানায়, “ট্রাম্প বৈঠক ডেকেছিলেন, পরে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কলিন্স ও ডাফি প্রকাশ্যে মাস্ককে ‘মিথ্যাবাদী’ বলেছিলেন।”
“বিগ বিউটিফুল বিল” নামে পরিচিত ট্যাক্স আইনটি এই দ্বন্দ্বের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে দাবি করেন যে মাস্ক এই বিলের খসড়া দেখেছেন। মাস্ক সঙ্গে সঙ্গে এক্স-এ লিখে তা অস্বীকার করেন, “মিথ্যা। এই বিলের খসড়া কখনও আমাকে দেখানো হয়নি। রাতারাতি পাস করা হয়েছে, যাতে কংগ্রেসের কেউই ভালোভাবে পড়তে পারেনি!”
ট্রাম্প পাল্টা অভিযোগে বলেন, “আমি ওকে বলেছিলাম সরে যেতে, ওর কৃত্রিম গাড়ির ম্যান্ডেট বাতিল করে দিয়েছিলাম, ও জানতো!” মাস্ক সঙ্গে সঙ্গে “অবশ্যই মিথ্যা” বলে পাল্টা দেন।
২০২৫ সালের ২৭ মার্চ ফক্স নিউজে মাস্ক বলেছিলেন, “আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট একজন সৎ মানুষ।” কিন্তু তার কয়েক মাস পরেই ট্রাম্পকে মিথ্যাবাদী বলার ঘটনা—এটি সম্পর্কের নাটকীয় রূপান্তরকে প্রমাণ করে।
মাস্কের নেতৃত্বাধীন “ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি কর্মসূচি, ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ এবং মাস্কের ইভি ( সেক্টর—এই সবকিছুই তাদের মধ্যে বিরোধ বাড়িয়ে তোলে। মাস্ক ট্যাক্স বিলের সমালোচনা করে বলেন, “এটি কংগ্রেসের বেহুদা খরচে ভরা, জঘন্য!” কিন্তু হোয়াইট হাউজ তা উপেক্ষা করে।
ট্রাম্পের বিজয়ে নিজের কৃতিত্ব দাবি করে মাস্ক বলেন, “আমার ছাড়া ট্রাম্প হারতো।” ট্রাম্প তার পাল্টা অভিযোগে বলেন, “ওর ইভি ট্যাক্স ক্রেডিটের জন্যই এসব করছে।” মাস্ক তখন ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে কটাক্ষ করেন।
এই দ্বন্দ্ব রিপাবলিকান দলে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে এবং ডেমোক্র্যাটদের আনন্দিত করেছে। ট্রাম্প হুমকি দেন, “ইলনের সরকারি ভর্তুকি ও কন্ট্র্যাক্ট বাতিল করে দেব।” তাতে টেসলার শেয়ার ১০% পড়ে যায়, প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।
ইলন মাস্ক ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই অস্থির সম্পর্ক এবং তার তিক্ত সমাপ্তি দেখায়, ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ কিভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে বিশাল প্রভাব ফেলে। তাদের দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতের রাজনৈতিক মিত্রতার জন্য সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে।