ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ উত্তেজনার ছায়ায় বাংলাদেশ | চ্যানেল আই অনলাইন

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ উত্তেজনার ছায়ায় বাংলাদেশ | চ্যানেল আই অনলাইন

২২ এপ্রিল সকালটা ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। রাজধানীর টিপিক্যাল ট্রাফিক, হকারের হাঁকডাক, ব্যস্ত অফিসগামী মানুষের ভিড়। কিন্তু একসময় সেই ভিড়ের মাঝে, একটি টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠল ব্রেকিং নিউজ- ‘ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা’। ভারতের অভিযোগের তীর পাকিস্তানের দিকে। এরপর দুই প্রতিবেশী দেশের ক্রমবর্ধমান বৈরিতা যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি করছে। বাংলাদেশে বাড়ছে অস্থিরতা, প্রশ্ন জাগে: যুদ্ধ যদি লাগে, আমরা কোথায় দাঁড়াবো?

দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের দ্বন্দ্বে আরেক প্রতিবেশী বাংলাদেশের উদ্বেগ বাড়ছে। এই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে অর্থনীতিবিদদের টেবিলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফাইলে, এমনকি সীমান্তে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাদের টহল রিপোর্টেও। কারণ ভারতের ওপর নির্ভরতা যেন তলোয়ারের দুই ধার। দেশের আমদানি-রপ্তানি, ফ্লাইট যোগাযোগ, সীমান্ত নিরাপত্তা, রাজনৈতিক পরিবেশ— কোনো কিছুই এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয়।

তাই যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা কিংবা সামান্যতম সংঘর্ষের ঘটনাও দেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

প্রস্তুতি নেয়া ভালো

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার (৩০ এপ্রিল) বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বার্ষিক বিশেষ মহড়া ‘আকাশ বিজয়-২০২৫’ অনুষ্ঠানে বলেন, পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি। সেখানে প্রস্তুতি না নিয়ে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় হয় অবস্থা। এই পরিস্থিতির মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি না নেয়াটা আত্মঘাতী।

ছোট পরিসরে হামলা চালানো হলেও যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা খুবই কম – ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে বলে জানান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, বর্ডারে আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। কারণ যুদ্ধ হলে ইমপ্যাক্ট পড়বে। প্রস্তুতি নেয়া ভালো।আমাদের পলিসি মেকারদের দায়িত্ববান বক্তব্য রাখতে হবে। তারা যেন উল্টো-পাল্টা কথা না বলে। তাহলে সমস্যা হতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

ইতিমধ্যেই যুদ্ধ শুরু

লেখক ও ইতিহাস গবেষক আলতাফ পারভেজ বিষয়টিকে দেখছেন আরও গভীরভাবে। তার ভাষায়, যুদ্ধ তো শুরু হয়েই গেছে। ভারত পাকিস্তানের সাথে একটি যুদ্ধ শুরু করেছে, আরেকটি করছে অভ্যন্তরীণভাবে। যেখানে তারা মুসলিমদের টার্গেট করেছে। সেখানে যে অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িকরণ করা হচ্ছে তার একটা ছাপ পড়বে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এবং বাংলাদেশেও পড়বে।

ভারতের মিডিয়া কোন না কোনভাবে বাংলাদেশকে জড়াবেই – আলতাফ পারভেজ

বাংলাদেশ পারমাণবিক ঝুঁকিতে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুই দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। ফলে বাংলাদেশ চরম যুদ্ধ বিদ্ধংসী যুদ্ধ হুমকির মুখে রয়েছে। এটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। একটা পারমাণবিক বোমা ফাটলেও তা বাংলাদেশে লাগবে।

জড়ানো হচ্ছে বাংলাদেশকে

দায়িত্বশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বশীল অবস্থান নিতে হবে। হুটহাট কোনো মন্তব্য যেন উত্তেজনা বাড়িয়ে না দেয়।

‘আমার বিশ্বাস, পহেলগামের ঘটনায় ভারতের মিডিয়া কোন না কোনভাবে বাংলাদেশকে জড়াবেই। গুজরাট আটকের ঘটনা দেখুন। মানে আস্তে আস্তে বাংলাদেশকে ঢুকানো হচ্ছে-বলেন আলতাফ পারভেজ।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ভারতে গুজরাট পুলিশ শনিবার ভোর রাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে আটক করেছে, যারা বাংলাদেশি নাগরিক বলে পুলিশের সন্দেহ। তবে তাদের বেশিরভাগই ভারতীয় নাগরিক আর নিশ্চিতভাবে কেবল ৪৫০ জন বাংলাদেশিকে তারা চিহ্নিত করতে পেরেছেন।

লেখক ও ইতিহাস গবেষক আলতাফ পারভেজ

ভারত নির্ভরতার প্রভাব অর্থনীতিতে

সমাধানের বিষয়ে জোর দেন অর্থনীতি গবেষক মাহা মির্জা। বলেন, আমাদের আমদানিতে ভারত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যুদ্ধ হলে ভারতের যেকোন সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই দেশিয় শিল্পে সরকারকে মনযোগী হতে হবে।

আমদানিতে ভারত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে – মাহা মির্জা

‘যুদ্ধ হলে বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে’ জানতে চাইলে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, যুদ্ধ হলে শুধু বাংলাদেশ না, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই একটি প্রভাব পড়বে। সাপ্লাই চেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, শিপিং সব কিছুতেই প্রভাব পড়বে। তবে ছোট হামলা হলে আমার মনে হয় না, বাংলাদেশে তেমন কোন ইমপ্যাক্ট পড়বে।

আলতাফ পারভেজ বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যতেও প্রভাব পড়বে। বিমান চলাচল নিষেধাজ্ঞা, সিন্ধু-সিমলা চুক্তি বাতিল, এই বিষয়গুলোর একটি সাইড ইফেক্ট পড়বে বাংলাদেশে। বিষয়টি আমরা দেখতে পারছি প্রাণ-প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মত করে।

আমাদের আমদানিতে ভারত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ মাহা মির্জার

আশার কথা

ছোট পরিসরে হামলা চালানো হলেও যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করেন ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, যেহেতু ভারতের মানুষের মধ্যে একটি ইমোশন কাজ করছে তাই ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এর মত কিছু করতে পারে। বড় পরিসরে যুদ্ধ করার মত পরিস্থিতি দেখতে পারছি না এখনও।

ভারত-পাকিস্তানের বর্তমান চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান খুব স্পষ্ট বলেও উল্লেখ করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। যে কোন উপায়েই দুই দেশের উত্তেজনা যাতে প্রশমিত হয় সেটি বাংলাদেশের কামনা বলে জানিয়েছেন তিনি।

রোববার (২৭ এপ্রিল) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, আমরা চাইবো ভারত–পাকিস্তান দুই দেশের সাথেই আমাদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান হোক। আমরা চাইবো যে তারা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান করে ফেলুক।

Scroll to Top