‘দুর্নীতির অভিযোগের মুখে’ জুলাই শহীদ পরিবারের আবাসন প্রকল্প ফেরত

‘দুর্নীতির অভিযোগের মুখে’ জুলাই শহীদ পরিবারের আবাসন প্রকল্প ফেরত

উত্তরাধিকার, যথাযথ ব্যয় প্রাক্কলন ও স্থান হিসেবে শুধু রাজধানী ঢাকার মিরপুরে কেন- এমন সব প্রশ্ন ওঠায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের জন্য ৮০৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণের একটি প্রকল্পের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।

‘দুর্নীতির অভিযোগের মুখে’ জুলাই শহীদ পরিবারের আবাসন প্রকল্প ফেরত‘দুর্নীতির অভিযোগের মুখে’ জুলাই শহীদ পরিবারের আবাসন প্রকল্প ফেরতপ্রকল্প প্রস্তাবে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর এ সিদ্ধান্ত এলো।

রবিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে একনেক সভায় আবাসন প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক সভা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। সভায় ৮ হাজার ১৪৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ১২ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলেও জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা।

গত ১ জুলাইয়ের গেজেট অনুযায়ী গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা ৮৪৪ জন। প্রস্তাবিত প্রকল্পে ঢাকার মিরপুরে ৮০৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কথা বলা হয় ৭৬১ কোটি ১৬ লাখ টাকায়।

সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “ঢাকার মিরপুরে এক হাজার ৩৫৫ বর্গফুটের ৮০৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণের একটি প্রকল্প এসেছিল বৈঠকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে। বৈঠকে এই প্রকল্প নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ব্যয় ঠিকমতো ধরা হয়েছে কিনা এবং একাধিক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের কথাও উঠেছে।”

এছাড়া আন্দোলনে সারা দেশে শহীদ হলেও শুধু ঢাকায় আবাসন প্রকল্প করা হলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কিনা; যথাযথভাবে প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন নিয়ে প্রশ্নসহ বেশ কয়েকটি কারণে প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

সেসময় সাংবাদিকরা জানতে চান- তাহলে প্রকল্পটি বাতিল হলো, নাকি অধিকতর যাচাই-বাছাই করতে বলা হলো?

জবাবে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “প্রকল্পটি বাতিল আর স্থগিত একই কথা। এইভাবে না। আবার যাচাই-বাছাই করে এগুলোর ব্যয় প্রাক্কলন করা হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সমন্বয়। আর যেসব সমস্য দেখা দিতে পারে উত্তরাধিকারের সমস্যা। ঢাকাতেই কেন থাকতে হবে; অন্য জায়গায় থাকলে কী হবে- এগুলো যাচাই-বাছাই না করে হঠাৎ করে এরকম প্রস্তাব চলে এসেছে।”

তিনি বলেন, “শহীদ পরিবারগুলোকে এই সুবিধা দিতে গেলে এখানে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন উঠবে। শুধু ঢাকাতেই, মিরপুরে কেন? অনেকে তো গ্রামাঞ্চলে এবং অন্য শহরে থাকে।”

একনেকে উত্থাপিত প্রস্তাবে দেখা যায়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২৪ এ শহীদ পরিবারের স্থায়ী বাসস্থান প্রদানের নিমিত্ত জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জমিতে ‘৩৬ জুলাই’ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৬১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের জন্য এর মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল এ বছরের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন।

পরিকল্পনা কমিশনে গত ১৬ জুন প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পটিরে বাস্তবায়নে নানা জটিলতার কথা তুলে ধরা হয়। পরে এর প্রাথমিক তদন্তে বিভিন্ন ব্যয়ে বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে বলে একাধিক সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়।

একনেক বৈঠকে আসা প্রস্তাবটি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের।

অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে এসব শহীদ পরিবারের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কেই এটাকে সমন্বয় করতে হবে।”

প্রকল্পের এই ব্যয়ের প্রাক্কলনের যথার্থতা নিয়ে একনেক সভায় প্রশ্ন ওঠার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “এটা একটা ভালো উদ্যোগ বলে আমরা মনে করেছিলাম। কিন্তু এটা আমরা গ্রহণ করিনি। কারণ এটার কাগজপত্র দেখে আমাদের মনে হয়েছে, যথাযথভাবে খরচের মূল্যায়ন হওয়া উচিত টেন্ডারে যাওয়ার আগে।

“আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য শহীদ পরিবারগুলোর মধ্যে আসতে থাকলে কোথায় যে ফাঁক আছে আর কোথায় যে নেই, দুটো একত্র হয়ে যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না।”

পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “এখন থেকে আমরা মনে করছি, শহীদ পরিবারের জন্য এই প্রকল্প এবং আরও প্রকল্প আছে। তাছাড়া ওইসব পরিবারের জন্য ভাতাসহ আরও যেসব ব্যবস্থা আছে এবং যারা পঙ্গু হয়েছেন তাদের জন্য যেসব সাহায্য দেওয়া হচ্ছে সবগুলোকে এক জায়গায় এনে সমন্বিত করা উচিত। তখন এটাকে কতদূর কী করা যায় তা ঠিক করা উচিত।”

৮ হাজার ১৪৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ১২ প্রকল্প অনুমোদন

একনেক রবিবার ৮ হাজার ১৪৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ১২টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, একনেকের চেয়ারপারসন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে একনেক সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়।

অনুমোদিত ১২টি প্রকল্পের মধ্যে ছয়টি নতুন, চারটি সংশোধিত এবং ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদ বৃদ্ধির দুইটি প্রকল্প রয়েছে।

অনুমোদিত ১২টি প্রকল্প হলো- গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু হতে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ (২য় সংশোধিত ৪র্থ বার বৃদ্ধি) প্রকল্প। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুইটি প্রকল্প (১) ‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ২০টি (১২টি নতুন ও আটটি ফায়ার স্টেশন পুনঃনির্মাণ) ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ষ্টেশন স্থাপন’ এবং (২) ‘বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জন্য লজিস্টিকস ও ফ্রিট মেইনটেন্যান্স ফ্যাসিলিটিস গড়ে তোলা (প্রস্তাবিত ২য় সংশোধিন)। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দুইটি প্রকল্প, (১) ‘গ্রামীণ স্যানিটেশন প্রকল্প’ এবং (২) ‘বহদ্দারহাট বাড়াইপাড়া হতে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ (৩য় সংশোধিন) প্রকল্প। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প ‘মিরপুর সেনানিবাসে ডিএসসিএসসি’র অফিসার্স মেস ও বিওকিউ নির্মাণ’ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিকতর উন্নয়ন’ প্রকল্প। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, ‘উপজেলা পর্যায়ে মহিলাদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ (২য় পর্যায়)’। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের জাদুঘর ভবন সম্প্রসারণ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ’ (১ম সংশোধিত ৪র্থ বার বৃদ্ধি)। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি ‘কন্দাল ফসল গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্প। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অফ বিপিডিবি (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে।

সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা কর্তৃক ইতোমধ্যে অনুমোদিত ১৮টি প্রকল্প সম্পর্কে একনেক সদস্যদের অবহিত করা হয়।

সেগুলো হলো- ১. গ্রাম সড়ক পুনর্বাসন প্রকল্প (২য় সংশোধিত), ২. ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, ৩. পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, ৪. ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস চাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্প, ৫. হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প, ৬. বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙ্গন এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ (৩য় পর্যায়) (২য় সংশোধিত), ৭. বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ (২য় সংশোধিত), ৮. গাজীপুর সাফারী পার্কের অত্যাবশ্যকীয় ব্যবস্থাপনা সহায়ক প্রকল্প, ৯. যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (২য় সংশোধিত), ১০. জিএনএসএস করস এর নেটওয়ার্ক পরিধি সম্প্রসারণ এবং টাইডাল স্টেশন আধুনিকীকরণ (২য় সংশোধিত), ১১. ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ৪৩ নং ওয়ার্ডের ৩০০ ফুট পূর্বাচল সড়ক সংলগ্ন তলনা এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন, ১২. রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন (১ম সংশোধিত), ১৩. আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অস্ত্রাগার (১ম পর্যায়ে ৪০টি) নির্মাণ (২য় সংশোধিত), ১৪. চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ নৌবাহিনী ডকইয়ার্ড টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো উন্নয়ন ও বর্ধিতকরণ, ১৫. ফেনী পৌরসভা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (২য় সংশোধিত), ১৬. জামালপুর জেলা কারাগার পুনঃনির্মাণ (১ম সংশোধিত), ১৭. শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন (২য় সংশোধিত), ১৮. দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-২০২৪ এর অডিও ভিজ্যুয়াল দলিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং প্রকল্পের ২টি নাম পরিবর্তন ১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামন নভোথিয়েটার, বরিশাল স্থাপন (২য় সংশোধিত) এর পরিবর্তে নভোথিয়েটার, বরিশাল স্থাপন (২য় সংশোধিত) ২. মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) এর পরিবর্তে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় সেচ উন্নয়ন প্রকল্প।

Scroll to Top