থ্রি-জিরো তত্ত্ব: বাংলাদেশ হাঁটছে স্বপের পথে | চ্যানেল আই অনলাইন

থ্রি-জিরো তত্ত্ব: বাংলাদেশ হাঁটছে স্বপের পথে | চ্যানেল আই অনলাইন

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

মীর আব্দুর আলীম: বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এর থ্রি-জিরো তত্ত্ব বাস্তবায়ন করেছে অনেক উন্নত বিশ্ব। বাংলাদেশও তার হাত ধরে এখন থ্রি-জিরো যুগে ঢুকতে যাচ্ছে। শুনেই গর্বে বুক ফুলে উঠল। কী সেই থ্রি-জিরো? (১) শূন্য দারিদ্র্য! (২) শূন্য বেকারত্ব! (৩) শূন্য কার্বন নিঃসরণ! তিনটা শূন্য, মানে কিছুই নেই-ভাবলে ভুল করবেন। এই তিনটা শূন্য কিন্তু আমাদের ভবিষ্যতের তিনটা গোল না, গোলপোস্টে শট মারা গোল না, টার্গেট টাইপ।

দেশের এক চা দোকানে বসে মজনু ভাই বললেন, “ভাইরে, এই থ্রি-জিরো মানে হইল-একদিন এমন আসবে, যখন কেউ কারো কাছে পাঁচ টাকা ধার চাইবে না, কারণ সবার পকেটে টাকা থাকবে।” পাশে বসা কবির ভাই বললেন, “আর কেউ বেকার থাকব না, সবাই হইব ইউটিউবার।” আরেকজন মুচকি হেসে বলল, “কার্বন থাকব না, শান্তিতে নি:শ্বস নিতে পারব আমরা!” এতটা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে মনে হয় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেটা কল্পনার জাহাজে উঠে প্ল্যানেট মার্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে-তাও আবার ইলেকট্রিক জাহাজে, পেছনে কোন ধোঁয়া নাই।

এই থ্রি-জিরো এমন এক চমৎকার জিনিস, যেটা শুনলে আপনার মনও শূন্যের মতো হালকা হয়ে যাবে। আর মনের বোঝা কমলে জীবন হবে ইকো-ফ্রেন্ডলি! সবশেষে বলি- যদি এই তিন শূন্য বাস্তবে আসে, তাহলে বাংলাদেশ হবে একমাত্র দেশ, যেখানে স্বপ্ন দেখা আর বাস্তব হওয়া, দুটোই একসাথে ঘটে। কেউ যদি বলে, “এটা কি আদৌ সম্ভব?” তাকে বলুন, “স্বপ্ন দেখাও একটা কাজ, অন্তত বেকারত্ব তো কমে!”

সত্যিই একুশ শতকের তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নতুন এক স্বপ্নের দিকে পা বাড়াচ্ছে। থ্রি জিরো থিওরি- শুধু উন্নয়ন নয়, বাংলাদেশ এখন দিচ্ছে টেকসই উন্নয়নের সংকেত। বাংলাদেশ অতীতে দেখিয়েছে- স্বপ্নে আগুন ধরলে ইতিহাস বদলে যায়। থ্রি জিরো তত্ত্ব হয়তো আজ গবেষণার বিষয়, কাল সেটিই হতে পারে নীতিনির্ধারকের পরিকল্পনার মূলমন্ত্র। তবে শর্ত একটাই- স্বপ্ন দেখার সঙ্গে বাস্তবতার সংলাপ চলতে হবে প্রতিটি স্তরে। কথা একটাই! বাংলাদেশ দেখছে স্বপ্ন, শুনছে বিশ্ব। এবার দরকার একটাই— বাস্তবতার চাবিকাঠি হাতে স্বপ্নের দরজা খোলা।

শূন্য দারিদ্র্যের স্বপ্ন: কৌশল, বাস্তবতা ও দুর্নীতির প্রাচীর?

বাংলাদেশ পরপর বছর ধরে দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনছে, এটা সত্য। তবে “শূন্য দারিদ্র্য”- শব্দটা যতটা দার্শনিক, তার বাস্তবায়ন ততটাই কৌশলনির্ভর। গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ, ডিজিটাল সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো ও ক্ষুদ্রঋণ মডেল অনেকটা এগিয়েছে। বাংলাদেশকে এখন আর ‘চরম দরিদ্র’ বলার সুযোগ নেই। গত এক যুগে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতি, নারীশ্রমের ব্যাপক অন্তর্ভুক্তি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার চোখে পড়ার মতোভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০০০ সালে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ মানুষ, এখন তা কমে এসেছে ১৮.৭ শতাংশে (২০২৩-২০২৪ এর সরকারি তথ্য অনুযায়ী)। এ অর্জন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে প্রশ্নটা ঠিক এখানেই এসে দাঁড়ায়— ‘শূন্য দারিদ্র্য’ কি শুধুই একটি কল্পলোকের শব্দ? নাকি তার বাস্তবায়নও সম্ভব, যদি রাষ্ট্র চায়?

বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসে যেসব কৌশল ভূমিকা রেখেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ। শহর-কেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এখন গ্রামেই তৈরি হচ্ছে ক্ষুদ্র কলকারখানা, ই-কমার্স হাব, কৃষি প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র। কৃষি পণ্যের ডিজিটাল বিপণন, কৃষক কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি, এবং মোবাইল ব্যাংকিং-এর সুবিধায় আজ গ্রামের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে গতিশীল। ডিজিটাল সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো— আরেকটি মাইলফলক। আগে যেখানে বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা বা প্রতিবন্ধী ভাতায় প্রচুর অনিয়ম ছিল, এখন সেগুলো যাচাই-বাছাই করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে সরাসরি ভুক্তভোগীর একাউন্টে চলে যাচ্ছে।

আর ক্ষুদ্রঋণ? বাংলাদেশেই যার জন্ম, সেই মডেল এখন বিশ্বে স্বীকৃত। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, এবং অন্যান্য এনজিও সংস্থাগুলো দরিদ্র নারীদের হাতে পুঁজি তুলে দিয়ে একদিকে স্বনির্ভরতা তৈরি করেছে, অন্যদিকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য তৈরি করেছে ক্ষুদ্র অর্থনীতির এক নতুন বলয়। দারিদ্র্যের রূপরেখা বদলেছে। পরিসংখ্যান বলছে দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে, তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে দারিদ্র্যের মানগত রূপান্তর নিয়ে। আজকের দরিদ্র মানুষটি হয়তো মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, দিনে দুই বেলা খেতে পান, কিন্তু তিনি এখনো অস্থায়ী শ্রমিক, কোনো সামাজিক নিরাপত্তার ছায়ায় নেই, এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবন একেবারে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। এই অবস্থাকে কি সত্যিকার অর্থে ‘দারিদ্র্যমুক্ত’ বলা যায়?

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন— একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ছাড়া কি আদৌ ‘শূন্য দারিদ্র্য’ সম্ভব? এখানে এসে গোটা আলোচনার মোড় ঘুরে যায়। দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ খাদ্যশস্য কালোবাজারে যায়, ভাতার তালিকায় ধনী আত্মীয়দের নাম উঠে আসে, কৃষি উপকরণে চুরি হয়, রেশন কার্ডে ফাঁকি থাকে। শুধু তৃণমূল নয়—মাঝারি স্তরের আমলাতন্ত্র, জনপ্রতিনিধি ও দলীয় প্রভাবশালী নেতারা কোথাও না কোথাও এই সিস্টেমে জড়িয়ে আছেন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র জনগণের জন্য ঘোষিত প্রকল্পের মধ্যে অনেকেই প্রকৃত সুবিধাভোগী হতে পারেন না— প্রশাসনিক জটিলতা, ঘুষ, বা ‘পার্সেন্টেজ সংস্কৃতি’র কারণে।

ভারতের অভিজ্ঞতা:

ভারতের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ বা ‘মনরেগা’এর মতো কর্মসূচিগুলোও একই চ্যালেঞ্জে ভোগে— দুর্নীতি, ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়ন, এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কিন্তু ভারতে একদিকে যেমন রয়েছে শক্তিশালী তথ্য অধিকার আইন, অন্যদিকে সোচ্চার নাগরিক সমাজ— যা কিছুটা হলেও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে এখনো সেই মাত্রার নাগরিক চেতনা বা তথ্য অ্যাকসেসের জোর নেই।

‘শূন্য দারিদ্র্য’-শব্দটা শুনতে যেমন শোভন, বাস্তবে তা অর্জন করা ততটাই কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। শর্ত একটাই- নৈতিক প্রশাসন ও কার্যকর জবাবদিহি। যখন রাষ্ট্র সত্যিই দরিদ্র জনগণের পাশে দাঁড়ায়, যখন দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে কঠোর হাতে দমন করা হয়, তখনই এই স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবতায় রূপ নিতে পারে। কৌশল যথেষ্ট আছে, সংস্থানও বাড়ছে। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক সততা, এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার সংস্কৃতি। নাহলে উন্নয়নের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকলেও, নিচের মাটিটা ফাঁপা থেকে যাবে।

শূন্য বেকারত্ব ডিজিটাল শ্রমবাজারে উঁকি:

“বেকারত্ব” আর “দক্ষতা ঘাটতি”- এই দুইয়ের মাঝে আটকে আছে দেশের তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশ প্রতিবছর লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, কিন্তু যোগ্যতার সঙ্গে মিলছে না চাকরির ক্ষেত্র। তবে আইটি ফার্ম, রিমোট জব, গিগ ইকোনমি- এসবই দেখাচ্ছে সম্ভাবনার নতুন পথ। তরুণদের মুখে আজ শোনা যাচ্ছে এক নতুন ভাষা: “ফ্রিল্যান্সিংই আমার চাকরি!” তবুও একটাই চিন্তা! ১৭ কোটি মানুষের দেশে শূন্য বেকারত্ব- ইউটোপিয়া নাকি লক্ষ্যের ধ্রুবতারা? বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পেরিয়ে আসা তরুণটি যখন দেখে, তার চারপাশের প্রায় সবাই বেকার কিংবা খণ্ডকালীন অনিশ্চিত কিছু করছে, তখন তার মনে হয়-শিক্ষা কি তবে ব্যর্থ? নাকি শ্রমবাজারটাই বাস্তবতাহীন?

বাংলাদেশের এই বেকারত্ব সমস্যা অনেক পুরনো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে আরেকটি শব্দ ক্রমে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে-তা হল ‘দক্ষতা ঘাটতি’। একদিকে চাকরির অভাব, আরেকদিকে চাকরিদাতা বলছে, “যোগ্য প্রার্থী নেই!” দুটোই যেন সঠিক, আবার দুটোই যেন বিভ্রান্তিকর। এই দ্বন্দ্বের মাঝে তরুণদের সামনে এক নতুন জানালা খুলেছে-ডিজিটাল শ্রমবাজার। ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট জব, গিগ ইকোনমি-এসব শব্দ আজ আর শুধু পত্রিকার কলামেই থাকে না, তরুণদের জীবনপথ নির্ধারণেও বড় ভূমিকা রাখছে। “ফ্রিল্যান্সিংই আমার চাকরি”-এ কথাটি এখন আর কৌতুক নয়, এক নতুন বাস্তবতা। অনলাইনে কাজ পাওয়া, ক্লায়েন্টের সঙ্গে ভিডিও কলে আলোচনা, আন্তর্জাতিক পেমেন্টে মাসিক আয়-সব মিলিয়ে এক নতুন পেশাগত ভাষা তৈরি হয়েছে, যেখানে অফিস বলতে নিজের ল্যাপটপ, আর সময় বলতে নিজের সুবিধেমতো ঘড়ির কাঁটা।

আর আশার কথা হলো বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম বড় ফ্রিল্যান্সিং হাব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তরুণরা কাজ করছেন ওয়েব ডিজাইন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, ইউএক্স/ইউআই ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, এমনকি কনটেন্ট রাইটিং বা ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও। শুধু ঢাকা নয়-মাদারীপুর, পিরোজপুর, কুড়িগ্রাম কিংবা টাঙ্গাইলের গ্রাম থেকেও এখন ডলার আয় হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি যেন তরুণদের বেকার জীবনের অন্তত একটি রুটিন ভাঙার দাওয়াই হয়ে উঠেছে।

সরকারের পক্ষ থেকেও আইটি খাতে উদ্যোগ কম হয়নি। ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্প, হাইটেক পার্ক নির্মাণ, জেলা পর্যায়ে ট্রেনিং সেন্টার-এসব প্রয়াস এক ধরনের আশার আলো জ্বালিয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই ডিজিটাল উত্থান কি সত্যিই শূন্য বেকারত্ব আনতে পারবে? নাকি এই আশাবাদ আমাদের এক ইউটোপিয়ান কল্পনায় ভাসিয়ে নিচ্ছে? যদি লক্ষ রাখি, বাংলাদেশে এখনো বিপুল সংখ্যক তরুণ আছে যাদের কাছে ইন্টারনেট মানে শুধু ফেসবুক কিংবা ইউটিউব। অনেকেরই নেই পর্যাপ্ত কম্পিউটার স্কিল, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বা আত্মবিশ্বাস। তার ওপর প্রযুক্তির এই দুনিয়াটিও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আজ যে স্কিল চাহিদা আছে, কাল তার জায়গায় চলে আসতে পারে নতুন কিছু। এই গতি ধরে রাখতে না পারলে ফ্রিল্যান্সিংও অস্থায়ী উত্তেজনার মতো মিলিয়ে যাবে।

একটি দেশের জন্য “শূন্য বেকারত্ব” নিঃসন্দেহে একটি গর্বের বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, সেটি সহজে অর্জনযোগ্য নয়। শুধুমাত্র ফ্রিল্যান্সিং বা গিগ ইকোনমির মাধ্যমে এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, যদি না তা হয় নীতিনির্ভর, কাঠামোগত, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। দরকার সর্বস্তরে ডিজিটাল শিক্ষা, শ্রমবাজারের জন্য প্রাসঙ্গিক ট্রেনিং, এবং নিরাপদ ও ন্যায্য অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থার। তবে সম্ভাবনার কথা বলতেই হয়-এই প্রথমবারের মতো আমাদের সামনে এমন এক বিশ্ব খুলে গেছে, যেখানে চাকরি খোঁজা নয়, চাকরি সৃষ্টি করার চিন্তা মাথায় আনা সম্ভব। তরুণদের হাতেই এখন প্রযুক্তির শক্তি, বিশ্বের দরজা তাদের আঙুলের ডগায়। শূন্য বেকারত্ব হয়তো আজ নয়, কাল নয়। তবে লক্ষ্য ঠিক থাকলে, পথ সঠিক হলে, সেটিই হতে পারে আমাদের আগামী দিনের বাস্তবতা।

শূন্য বেকারত্ব হয়তো একটি তাৎক্ষণিক বাস্তবতা নয়, তবে এটি হতে পারে একটি দূরবর্তী কিন্তু অর্জনযোগ্য লক্ষ্যের ধ্রুবতারা। ডিজিটাল শ্রমবাজার সেই পথে আমাদের প্রথম আলোকরেখা দেখাচ্ছে মাত্র। প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা, এবং তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা মানসিকতা জাগিয়ে তোলা—যাতে তারা শুধু চাকরি খোঁজার মানুষ না হয়ে, চাকরি সৃষ্টির রূপকার হয়ে উঠতে পারে।

শূন্য কার্বন মিশ্রণ: গ্রিন ফিউচারে ভবিষ্যত বাংলাদেশের-

বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার দেশগুলোর একটি। অথচ কার্বন নিঃসরণে তার অবদান নামমাত্র। তবুও “শূন্য কার্বন মিশ্রণ” লক্ষ্য গ্রহণ করেছে, এটা এক সাহসী ঘোষণা। গ্রিন এনার্জি, সৌর বিদ্যুৎ, জ্বালানি-দক্ষ প্রকল্প— এগুলোর উদ্যোগ অনেকটাই বাস্তবমুখী। বিশ্ব যখন কার্বন শূন্যতার পথে হাঁটছে, বাংলাদেশ সেখানে কী শুধু দর্শক থাকবে না পথপ্রদর্শকও হবে?

বাংলাদেশ এমন এক ভূগোলিক অঞ্চলে অবস্থিত, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে— ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, লবণাক্ততা, নদীভাঙন ইত্যাদির কারণে লাখো মানুষ প্রতি বছর বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। অথচ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান একেবারেই নামমাত্র— ০.৫ শতাংশেরও কম। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ‘শূন্য কার্বন মিশ্রণ’ এর মতো উচ্চাভিলাষী ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য গ্রহণ নিঃসন্দেহে এক সাহসী, দায়িত্বশীল ও দূরদর্শী পদক্ষেপ। সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার নীতিমালায় নবায়নযোগ্য শক্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি ও জ্বালানি-দক্ষ ভবন নির্মাণ, কৃষিক্ষেত্রে টেকসই পদ্ধতির ব্যবহার, এবং ইলেকট্রিক যানবাহনের প্রসার— এসব উদ্যোগ ইতোমধ্যে বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। “মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা”-র মতো কর্মসূচি প্রমাণ করে, বাংলাদেশ কেবল আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রত্যাশী নয়, বরং নিজ উদ্যোগেই পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করছে।

তবে প্রশ্ন থাকে— শুধু উদ্যোগ গ্রহণ করলেই কি তা যথেষ্ট? নাকি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও দক্ষতা, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রয়োজন? উন্নত দেশগুলো যখন নিজেদের ইতিহাসের জন্য দায়ভার নিতে কুণ্ঠিত, তখন উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ তাদের উদাহরণ টেনে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবতে হবে, বাংলাদেশ কি শুধু বিশ্ব জলবায়ু রাজনীতির দর্শক হয়ে থাকবে, নাকি সত্যিকারের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে? দেশের তরুণ প্রজন্ম, প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা, এবং গবেষকদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা এখন সময়ের দাবি।

স্থানীয় উদ্ভাবন, সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশ নিজস্ব মডেল গড়ে তুলতে পারে, যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। প্রকৃত পক্ষে, কার্বন শূন্যতা কোনো কল্পনাপ্রসূত ধারণা নয়- এটি একটি বাস্তব প্রয়োজন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নৈতিক দায়। বাংলাদেশ যদি এই পথে স্থির সংকল্পে এগিয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতের সবুজ পৃথিবীতে তার অবদান থাকবে গর্বের, সম্মানের এবং নেতৃত্বের আসনে।

বাংলাদেশের স্বপ্নের পথে হাঁটার সাহস:

বাংলাদেশ কি স্বপ্ন দেখতে পারে?- স্বপ্ন দেখা তো অপরাধ নয়, বরং সেটাই শক্তি। বাংলাদেশ অতীতে দেখিয়েছে— স্বপ্নে আগুন ধরলে ইতিহাস বদলে যায়। থ্রি জিরো তত্ত্ব হয়তো আজ গবেষণার বিষয়, কাল সেটিই হতে পারে নীতিনির্ধারকের পরিকল্পনার মূলমন্ত্র। তবে শর্ত একটাই- স্বপ্ন দেখার সঙ্গে বাস্তবতার সংলাপ চলতে হবে প্রতিটি স্তরে। কথা একটাই! বাংলাদেশ দেখছে স্বপ্ন, শুনছে বিশ্ব। এবার দরকার একটাই-বাস্তবতার চাবিকাঠি হাতে স্বপ্নের দরজা খোলা। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা এখন আর শুধু অর্থনীতির পরিসংখ্যান নয়, বরং একটা নতুন দর্শনের প্রতিচ্ছবি। “থ্রি-জিরো থিওরি”— দারিদ্র্য শূন্য, বেকারত্ব শূন্য, কার্বন মিশ্রণ শূন্য- এই তিন শূন্যতেই লুকিয়ে আছে শতভাগ সম্ভাবনার পূর্ণতা।

উপসংহার:

থ্রি-জিরো তত্ত্ব শুধু রাজনৈতিক বুলি নয়, বরং একটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নকশা। এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে আমাদের সম্মিলিত সদিচ্ছা, প্রস্তুতি এবং সততার ওপর। বাংলাদেশ কি পারবে? আমরা যদি প্রশ্নটি করি সাহসের সঙ্গে, উত্তরটিও আসবে গর্বের সুরে- হ্যাঁ, আমরা পারি। আমরা পারবই। এগিয়ে যাক বাংলাদেশ এই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক: মীর আব্দুল আলীম,

সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ। 

(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Scroll to Top