কানাডার শীর্ষ ইমিগ্রেশন ধান্দাবাজদের তালিকায় যার নামটি সকলের মুখে মুখে-
তিনি হচ্ছেন মাসুম চৌধুরী। ‘আরসিআইসি’ (Regulated Canadian Immigration Consultant) তার নামের অংশ হয়ে গেছে। তার ফেসবুক আইডিতে তিনি পরিচয় দিয়েছেন Founder & Regulated Canadian Immigration Consultant RCIC at Chowdhury Immigration and Visa Services Inc. বিশ্বজুড়ে তার বিশাল নেটওয়ার্ক! টরন্টো টু দুবাই, ঢাকা টু সিলেট। বিভিন্ন শহরে তার এজেন্ট (দালাল) নিয়োগ করা হয়েছে ক্লায়েন্ট ধরার জন্য। তার টার্গেট- স্বল্প শিক্ষিত পয়সাওয়ালা, নব্য ধনী, লুটেরা, এবং শিক্ষার্থী। ভিজিটর ভিসা, ইনভেষ্টর, ইন্টারন্যাশানাল ষ্টুডেন্ট সহ সকল ক্যাটাগরির ভিসা তিনি নিয়ে দিতে পারেন। কেননা তিনি হচ্ছেন ‘Chief Regulated Canadian Immigration Consultant and Lecturer of Canadian Immigration Law..’ (এই কথাগুলো তিনি তার ওয়েবসাইটে লিখে রেখেছেন)। আরও লেখা রয়েছে তিনি বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সকল দেশের ইমিগ্রেশন করে থাকেন। তার পোষ্টারে বাংলাদেশেরই টেলিফোন নম্বর রয়েছে ৯টি, অন্যান্য দেশের জন্য ১০টি এবং কানাডার জন্য দু’টি। ইমোতেও আলাদা নম্বর রয়েছে। জানা যায় তার গোপন নম্বর রয়েছে আরও এক ডজন।
প্রিয় পাঠক, গল্প শুরুর আগে আপনাদের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখে যাই।
১) মাসুম চৌধুরী কি Chief Regulated Canadian Immigration Consultant?
২) মাসুম চৌধুরী কি Lecturer of Canadian Immigration Law? (A lecturer is an academic expert who teaches and may also conduct research at a university or college.) তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন কলেজের লেকচারার?
৩) বর্তমান যুগে ১৫/২০টা নম্বর কোন ব্যবসায়ী বা কোন প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে? ইলন মাস্ক? মার্ক জাকারবার্গ? বার্নার্ড আর্নল্ট?
গল্পের শুরু (যদিও গল্প নয় সত্যি):
একটা সময় মাসুমকে সকাল সন্ধ্যা ড্যানফোর্থে দেখা যেতো। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ যখন ভিজিট ভিসা/ষ্টুডেন্ট ভিসায় আসতে শুরু করলো; মাসুম এবং তার মতো অনেকের ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। এ সময় মাসুম একটা অফিস নেন বাংলা পাড়ায়। রিফুউজি বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে নবাগত বাংলাদেশীদের কানাডার পিআর কার্ড দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে নগদ ডলার পকেটে পুরতে থাকেন তিনি। এরপর তাকে আর এ এলাকায় দেখা যায় না। লোকজন তাকে হন্য হয়ে খুঁজতে থাকে। কল করলে তিনি ফোন ধরেন না। ভুল করে ধরলেও তিনি মহাব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায় বাংলা পাড়ার অফিসে তিনি আর বসেন না। অর্থাৎ তার টরন্টোর অফিস বন্ধ। এখন তিনি পিকারিং এ তার বাড়িতে বসে হোম অফিস করেন।
দুবাই থেকে জনৈক মোহাম্মদ তারিক আজিজ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। অভিযোগে জানা যায়, ওয়ার্ক ভিসায় তাকে কানাডায় নিয়ে আসবেন বলে মাসুম তার কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা অ্যাডভান্স নেন। এরপর তাকে বিভিন্ন জাল কাগজপত্র পাঠিয়ে আরও অর্থ দাবী করতে থাকেন। তারিক আজিজ জানান, দুবাইতে বসবাসকারী বহু বাংলাদেশিদের কাছ থেকে তিনি এভাবে টাকা নিয়েছেন। এ অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা মাসুমকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন এটা তিনি নন। তার নামে ফেইক আইডি করে সাসকাচুয়ান থেকে ‘এমডি মাসুম চৌধুরী’ নামে কোনো এক ব্যক্তি এ প্রতারণা করেছে। (সত্যি কি তাই? স্ক্রিনশটগুলো কি বলে?)
মাসুম চৌধুরীর প্রতারণার তালিকা অনেক দীর্ঘ। ইন্টারন্যাশানাল ষ্টুডেন্ট ক্যাটাগরিতে আসা টরন্টোতে বসবাসকারী সিলেটের কয়েকজন তরুনী জানায়, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে মাসুম দুই হাজার ডলার করে অগ্রিম নিয়েছিলেন তাদের ষ্টেটাস পরিবর্তন করে দেয়ার জন্য। অর্থাৎ ষ্টুডেন্ট ষ্টেটাস থেকে রিফুউজি ষ্টেটাস প্রস্তুত করে দেয়ার জন্য। অগ্রিম অর্থ নেয়ার পর থেকে তিনি প্রথমে তাদের অপেক্ষা করতে বলে সময় ক্ষ্যাপন করতে থাকেন, এরপর নানান ভয়ভীতি দেখানো শুরু করেন, এবং একসময় যোগাযোগই বন্ধ করে দেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে উপায়ন্তর না দেখে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নেয়। অবশেষে তরুণীরা একজোট হয়ে তার পিকারিং-এর বাসায় হানা দিলে তিনি তাদের অর্থ ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আজ এক বছর হয়ে গেছে সে অর্থ তিনি ফেরত দেননি। তাদের ফোনও তিনি ধরেন না। অন্য নম্বর থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কণ্ঠ শুনে তিনি ফোন রেখে দেন।
বাটপারির চরম সীমানা লঙ্ঘনকারী মাসুম চৌধুরী সহজ সরল বাংলাদেশিদের ভয় ভীতি দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছেন। অজানা এক আতঙ্কে মুখ খুলছেন না প্রতারিত বাংলাদেশিরা। তারা মনে করেন, তাদের সকল ইনফরমেশন যেহেতু তার কাছে রয়েছে, তাই ইচ্ছে করলে তিনি ইমিগ্রেশনে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে পারেন। তিনি নাকি তার ক্লায়েন্টদেরকে হুমকি দিয়ে বলেছেন যদি তার নামে কোথাও অভিযোগ করা হয় তাহলে তিনি ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করে দেবেন যে তাদের আবেদন ভুয়া এবং জীবনে তারা কোনোদিন আর ‘পিআর কার্ড’ পাবে না।
এ বিষয়ে সিনিয়র কয়েকজন আইনজীবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা জানান, কেউ ইচ্ছে করলেই কোনো রিফুউজি আবেদনকারীর বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারে না বা বলতে পারে না অর্থাৎ কোনো অভিযোগ করতে পারে না। এটা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ এবং অনৈতিক। কর্তৃপক্ষ কাউকে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করার জন্য নিয়োগ দেয়নি বরং সহযোগিতা করতে উৎসাহ দিয়ে থাকে।
অনেকেই জানেন না যে, আরসিআইসির লাইসেন্স থাকলেও এ লাইসেন্সধারীরা কেউ কোর্টে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখেন না। মাসুম যে চালাকিটা করেন তাহলো তিনি লিগ্যাল এইডের যে কোনো একজন শিক্ষানবীশ অথবা নব্য আইনজীবীর সাথে তার ক্লায়েন্টদের অনলাইনে একটি ‘জুম মিটিং’ এ কথা বলিয়ে দেন। এ ভেলকিবাজিটি দেখিয়ে বেশি বেশি অর্থ আদায় করার এটা একটা কৌশল তার! এভাবে প্রায় হাজার খানেক রিফুউজি ক্লেমেন্টদের কাছ থেকে তিনি লক্ষ লক্ষ ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন।
মাসুমের মাধ্যমে রিফুউজি আবেদনকারীদের কয়েকজন জানিয়েছেন মাসুম তাদেরকে ইমিগ্রেশনে সাবমিট করা কোনো ডকুমেন্টের কপি প্রদান করেন না। এমনকি ইমেইল আইডি ক্লায়েন্টের নামে করে পাসওয়ার্ডটি তিনি তার কাছে রেখে দেন। ভুক্তভোগীদের মাধ্যমে আরও জানা যায়, বেশিরভাগ কেইস ষ্টোরি মাসুম কপি পেষ্ট করেন। তার বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে তিনি তার ক্লায়েন্টএর সাথে কোনো সার্ভিস এগ্রিমেন্ট (রিটেইনার) করার প্রয়োজন মনে করেন না এবং তিনি কাউকে টাকার রশিদও প্রদান করেন না।
এদিকে বাংলাদেশে গিয়ে মাসুম ঢাকা ও সিলেটের বিভিন্ন হোটেলে ইমিগ্রেশন বিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করে কানাডায় যেতে আগ্রহীদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। বহু লোককে তিনি ৩ মাসের মধ্যে নিয়ে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও অনেকে বছর ধরে অপেক্ষা করেও কোনো চিঠিপত্র পাননি। অথচ মাসুমের ফেসবুকে প্রায়ই ‘অমুকের ভিসা হয়ে গেছে’, ‘অমুক তিনবার রিফিউজ হওয়ার পর ভিসা পেয়েছেন’ বলে পোষ্ট দেন (পোষ্টগুলো দেখে পাঠক আপনি বিবেচনা করুন)। এতে অধিকতর মানুষ কানাডায় আসার জন্য তার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, কিছু মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।
প্রিয় পাঠক, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রতারকদের মুখোশ উন্মোচন করে সুস্থ সমাজ গঠনে সহযোগিতা করা, জনসচেতনতা তৈরি করা। প্রতারণার হাত থেকে সহজ-সরল মানুষদের রক্ষা করতে আপনিও এগিয়ে আসুন। আমি মনে করি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের প্রত্যেকের যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসা উচিত।