কক্সবাজারে বেড়েই চলছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা | চ্যানেল আই অনলাইন

কক্সবাজারে বেড়েই চলছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা | চ্যানেল আই অনলাইন

সাগরের পানি বৃদ্ধি, প্যারাবন উজাড়, অব্যাহত ভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দিন দিন বেড়েই চলেছে কক্সবাজার উপকূলের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা। সাগরের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে বসতি-গ্রাম-গঞ্জ। পেশা হারিয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

টেকনাফ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত কক্সবাজার উপকূল বর্তমানে দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জলবায়ু সংকটাপন্ন অঞ্চলের একটি। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়ার ফলে হাজার হাজার মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

ভিটা হারিয়ে পাহাড়ে আশ্রয়

ধলঘাটা ইউনিয়নের সাইটপাড়া গ্রামের আয়েশা বেগম ও আবুল বাশার দম্পতি গত ৪০ বছর ধরে বেড়িবাঁধের ওপর বাস করছেন। একসময় যেখানে একটি পূর্ণগ্রাম ছিল, এখন সেখানে মাত্র ২২টি পরিবার টিকে আছে। আয়েশা বেগম জানান, ঘূর্ণিঝড় আসলে আশ্রয়কেন্দ্রে যাই, পরদিন আবার ফিরে আসি। কিন্তু কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, জমিজমাও কিছু নেই।

ইউপি সদস্য মোক্তার আহমদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমার ওয়ার্ডের সবগুলো গ্রাম ভেঙে সাগরে বিলীন হয়েছে। এখানকার মানুষ শুধু ভোট দিতে আসে, বাকি সময় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায়।

আরেক ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম জানান, ধলঘাটার সরইতলা, বাদাম বুনিয়া, কিসরা বনিয়া, সাইটপাড়া, দক্ষিণপাড়াসহ বহু গ্রাম এখন আর মানচিত্রে নেই। এসব অঞ্চলে এখন শুধু জেলেরা মাছ ধরে।

বিপন্ন জীবিকা ও জীবন

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অনেকেই পূর্বে লবণ চাষ, মাছ ধরা কিংবা কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন। তবে পাহাড়ি এলাকায় স্থানান্তরের পর নতুন পেশায় মানিয়ে নিতে গিয়ে অনেকেই পড়েছেন চরম আর্থিক দুরবস্থায়। লবণ ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বলেন, যারা চলে গেছে, তারা এখানে লবণ চাষ করতো। এখন পেশা পরিবর্তন করে অনেকে বিপদে আছে। লবণের দামও নেই এখন।

সাবেক বাসিন্দা মোস্তাক আহমদ জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই এই অঞ্চলে ভাঙন শুরু হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভয়াবহ ধ্বংস সাধিত হয়, যার প্রভাব এখনও টিকে আছে।

সরকারি উদ্যোগ সীমিত, সংকট তীব্র

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বহু পরিবার এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে কিংবা অস্থায়ী বেড়িবাঁধের পাশে বসবাস করছে।

শিক্ষাবিদ মনজুর আলম বলেন, স্বাধীনতার পর তিনবার বাড়ি সরাতে হয়েছে। সর্বশেষ বাড়িটিও সাগরে চলে যাওয়ার পর অনেক বছর চট্টগ্রামে ছিলাম, এখন চকরিয়ায় বসবাস করছি। এরকম কয়েক হাজার মানুষ এখন জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছে।

কক্সবাজার উপকূলজুড়ে যে জলবায়ু উদ্বাস্তু সংকট তৈরি হয়েছে, তা শুধু স্থানচ্যুতি নয়—একই সঙ্গে জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে। এই সংকট মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, টেকসই বাঁধ, পুনর্বাসন এবং জীবনমান উন্নয়নের পদক্ষেপ না নিলে আগামী দিনে এই পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নিতে পারে।

Scroll to Top