আবার দেখা হবে, খালিদ?

আবার দেখা হবে, খালিদ?

আবার দেখা হবে, খালিদ?

আল মাহফুজ

জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও ‘চাইম’ ব্যান্ডের ভোকাল খালিদের আজ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছর এই দিনে (১৮ মার্চ) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন মেলোডির জাদুকর।

কয়েক বছর ধরেই হৃদরোগে ভুগছিলেন, একাধিকবার চিকিৎসকের শরণাপন্নও হন খালিদ। সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়া হয়। সন্ধ্যায় জানা যায়, হাসপাতালে নেয়ার আগেই প্রাণপাখি উড়ে গেছে হিমালয়সম এই শিল্পীর। সে রাতে কি বৃষ্টি ঝরেছিল?

এই গায়কের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে অর্পণ করছি শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল গত বছর। কিছুটা পরিমার্জন করে আজ তা তুলে ধরা হলো পাঠকের উদ্দেশে—

‘আবার দেখা হবে, এখনই শেষ দেখা নয়
আবার কথা হবে, এখনই শেষ কথা নয়..’

প্রিন্স মাহমুদের লেখা এই লিরিক কণ্ঠে তুলেছিলেন আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম জনপ্রিয় গায়ক। ভেবেছিলাম, বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা খালিদের কণ্ঠ থেকে বাংলাদেশের কোনো কনসার্টে আবার গানটি শোনার বরাত জুটবে। হয়তো খালিদ স্টেজ মাতাবেন ‘দূর পরবাসে’ থাকা আশিকুজ্জামান টুলুকে সঙ্গে করে। হয়তো আবার ‘চাইম’ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে টিএসসি, হাতিরঝিল এম্পফিথিয়েটারে। কিন্তু নাহ্‌, আমরা যা আশা করি, তার কতটুকু পূরণ হয়? লাখো লাখো সংগীতপ্রেমিকে কাঁদিয়ে খালিদ উড়াল দিলেন অন্য কোনো যাত্রায়। তবে খালিদ, আপনার সঙ্গে আমাদের আবার দেখা হবে। দেখা যে হতেই হবে!

কোনো কারণেই ফেরানো গেলো না তাকে..

যতোটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে, ততোটা মেঘ বুকে রেখেছি পুষে, কীভাবে আমায় তুমি কাঁদাবে বলো?

খালিদ কি অভিমান বুকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন? পুষেছিলেন গোপন কোনো ব্যথার জাল? এক আঁজলা যন্ত্রণায় কি বিদীর্ণ হচ্ছিল তার শিল্পী সত্তা? তা না হলে তিনি গাইবেন কেন– ‘একটা মানুষ কত সয়ে বাঁচতে পারে, একটা হৃদয় কত পুড়ে জ্বলতে পারে?’ প্রিন্স মাহমুদের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি। কিন্তু যারা গানটি শুনেছেন, তাদের বোধ হবে– বুকের ভেতর ভিসুভিয়াসের দহন না থাকলে এমন দরদ দিয়ে গাওয়া সম্ভব নয়। এই গায়কের বুকে কি হিমালয়সম দুঃখ ছিল? জানা হবে না হয়তো আর।

গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া এই শিল্পী ১৯৮১ সাল থেকে গানের জগতে যাত্রা করেন। খালিদের গান আশি-নব্বইয়ের দশকে পাড়া-মহল্লায় বাজতো। বাজতো বিপণিবিতানসহ ক্যাসেটের দোকানে। শ্রোতাদের মুখে মুখে থাকতো ‘নাতি খাতি বেলা গেল’, ‘আকাশনীলা’ অথবা নব্বইয়ের শেষের দিকে ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’। তারা গানটি শুনে নিজেদের জীবন থেকে বিদায় নেয়া প্রেমিকার কথা ভাবতো। খালিদ বাজতো ক্যাসেটে আর শ্রোতার হৃদয় স্মৃতির জাবরে মথিত হতো। কোনো বাঁধনেই কেন প্রিয়তমাকে ফেরানো যায়নি, এই অবিশ্বাস্য অনুতাপের আগুন জল হতো খালিদের গানে। সেই খালিদকে কোনো কারণেই কেন ফেরানো গেল না? তার উত্তর নেই। তবে বিদায়ের দিনে মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে– শিল্পীর মৃত্যু নেই, দেহাবসান হয় মাত্র

১৯৮৩ সাল থেকে ‘চাইম’ ব্যান্ডে যোগ দেন খালিদ। গানের জগতে তখন তার প্রবেশের বছর দুয়েক। চাইমের হয়ে একের পর এক মন মাতানো গান উপহার দিয়ে অল্প সময়েই খ্যাতি পান এই কণ্ঠশিল্পী। গত শতাব্দীর মানুষেরা খালিদকে চিনতো ‘চাইম’ ব্যান্ডের খালিদ নামেই। ‘কীত্তনখোলা’, ‘আজকে রাতে যে গান তুমি মোরে শোনালে’, ‘সেদিনও আকাশে ছিল চাঁদ‘, ‘মরে মরে বেঁচে আছে’, ‘পড়ালেখা শেষ করে’র মতো অসংখ্য গান এই গায়কের কণ্ঠে প্রাণ পেয়েছে। এক নতুন ‘টেস্ট অব মিউজিক’-এ মশগুল হয়ে পড়ে ব্যান্ডের শ্রোতারা।

চাইমে খালিদ

হয়নি যাবার বেলা, শুরুতেই সব কিছু শেষ করে কেন চলে গেছো?

চাইমের ভোকাল হলেও খালিদের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিলো একক গানেও। নব্বই বা শূন্য দশকে প্রিন্স মাহমুদের মিক্সড অ্যালবামে প্রায়ই পাওয়া যেতো খালিদকে। শ্রোতারা জেমস-আইয়ুব বাচ্চুর পাশাপাশি উৎকীর্ণ হয়ে থাকতো খালিদকে শোনার জন্য। ‘কোনো কারণেই’, ‘যদি হিমালয় হয়ে’, ‘নীরা ক্ষমা করো’, ‘ঘৃণা’, ‘আমায় যদি পড়ে মনে’, ‘ঘুমাও’, ‘এক মহাকাল ব্যথা’ ইত্যাদি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা প্রিন্স মাহমুদ। আর তরুণ মুন্সী লিখেছিলেন ‘সরলতার প্রতিমা‘। খালিদের কণ্ঠে এই গান অনুরণিত হওয়ার পর তা হয়ে যায় নতুন ইতিহাস!

খালিদের কণ্ঠ যেন পরশ পাথর, একবার শুনেই কানে লেগে থাকে। চোখ বুজে আসে সুরের সম্মোহনে। মনে দোলা দেয় বারবার। প্রতিবার যেন নতুন কিছু শোনার অভিজ্ঞতা। ‘হয়নি যাবার বেলা’ গানে খালিদ গেয়েছিলেন– ‘হয়নি যাবার বেলা, শুরুতেই সব কিছু শেষ করে কেন চলে গেছ?’ বিদায়ের মর্মর পাথরে আজ লেখা হোক আরক্ত এপিটাফ– ‘আমাদেরও তোমাকে কিছু বলার ছিল। বলা হলো না, প্রিয় শিল্পী। ভালোবাসার আখর অবজ্ঞা করে যাতনাকে সখ্য করা যায়?

যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে এ হৃদয়ে, সে কিছু নয়?

নব্বই দশকের পরিসমাপ্তি। বাংলাদেশের মিউজিকের প্রায় সবখানেই ভাঙনের সুর। কেউ কেউ ভিন্ন পথে হাঁটলেও যেন চোরাবালিতে ডুবে যান অল্প কদিনেই। কিছুতেই দেখা মিলছিলো না সোনালি সময়ের। খালিদও হারিয়ে গেলেন। অতল গহ্বরে। কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। একদিন বিদ্যুচ্চমকের মতো হঠাৎ ফিরে এলেন। প্রিন্স মাহমুদ খালিদকে দিয়ে গাওয়ালেন নতুন শতাব্দীর বিস্ময়কর এক গান। ততোদিনে ক্যাসেট-সিডির যুগের অবসান। এফএম রেডিওর দখলে বাংলা গান। সবগুলো রেডিও স্টেশনের শীর্ষে জায়গা করে নেয় প্রিন্স মাহমুদের গান– ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’। খালিদ ফিরলেন স্বমহিমায়। হয়ে গেলেন নতুন প্রজন্মের প্রিয় এক নাম।

হিমালয় নিয়ে ফিরলেন শিল্পী

এমন অজুত গানে কণ্ঠের মুন্সিয়ানায় খালিদ ছড়ালেন মহুয়ার সৌরভ। বাঙ্গালির অগুনতি মন খারাপের রাতের সঙ্গী ছিলেন এই গায়ক। এখনও মন খারাপ হলে শ্রোতারা হয়তো দরদিয়া শিল্পীর প্রিয় স্বরে আশ্রয় খোঁজে। এখনও রাতের জানলা খুললে আকাশ দেখা যাবে, বুকটা ভরে শ্বাসও নেয়া হবে কিন্তু ব্যথার জল কি যাবে নির্বাসনে? আহ, খালিদ! আপনি এভাবে চলে গেলেন!

আমায় যদি পড়ে মনে
কবিতায় কবিতায়
মগ্ন থেকো
আসে না যেনো জল
চোখেরই কোণে..’

Scroll to Top