Last Updated:
শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়াশোনা করা নয়, এই স্কুল শেখায় অনেককিছু

পশ্চিম মেদিনীপুরের কুচলাচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়
পশ্চিম মেদিনীপুর: মাত্র ২৫ বছরে পা দেওয়া জেলারই এক ছোট্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়। খুদে পড়ুয়াদের চিৎকার কোলাহলে মুখরিত থাকে সারাটা দিন। তবে জানেন, এই ছোট্ট এক বিদ্যালয় রয়েছে হাসপাতাল এমনকি ব্যাঙ্কও। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন ব্যাঙ্ক? হাসপাতালই বা কে গড়ে তুলল? যে ব্যাঙ্কের দায়িত্ব থাকে পড়ুয়াদের ঘাড়ে, শুধু তাই নয়, হাসপাতালের ডিউটি থাকে ছোট্ট ছোট্ট খুদেদের। শুধু তথাকথিত পুঁথিগত শিক্ষা দেওয়া নয়, নৈতিক শিক্ষা, সমাজের সামাজিকতা এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা লক্ষ্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। জেলারই প্রান্তিক এলাকার এমন একটি বিদ্যালয় গোটা জেলার কাছে দৃষ্টান্ত। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভাবনা চিন্তা সমাজের কাছে অনুপ্রেরণা।
একটি কাঁচের আলমারি। তার উপরে বড় বড় করে লেখা ‘ব্যাঙ্ক’। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঁচটি তাক। আর তাতেই থরে থরে সাজনো প্লাস্টিকের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বা টাকা রাখার ভাঁড়! প্রতিটি ভাঁড়ে লেখা আছে ছাত্রছাত্রীদের নাম। সঞ্জনা, রুবিনা, সৌমি, আফরিন, মানস, সাইনাদের ভাঁড়। যেখানে বাড়ি থেকে আনা সামান্য খুচরো পয়সা তারা নিজেদের ভাঁড়ে জমিয়ে রাখে। স্কুলের এই অফিস রুম থেকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই বারান্দার একটি নিরাপদ স্থানে রাখা আছে একটি খাট বা শয্যা। মাথার উপরে একটি টেবিল ফ্যান। স্কুলের মধ্যে বিছানা কেন? দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা ‘শুশ্রুষা হাসপাতাল’। বিভিন্ন তাকে রাখা আছে ‘ফার্স্ট এইড বক্স’ সহ নানা ওষুধপত্র। হাসপাতালের পরেই আছে ‘স্বাবলম্বী’ কক্ষ। সেখানে রাখা আছে সেলাই মেশিন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই ছোট্ট ও সুন্দর একটি অডিটোরিয়াম। আছে টিভি, প্রজেক্টর। না কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। এটি আসলে একটি সরকার পোষিত প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছবির মত সাজানো এই বিদ্যালয়। রেল শহর খড়গপুরের এমন একটি বিদ্যালয় গোটা জেলার কাছে নাম করেছে। খড়গপুর গ্রামীণের হিজলি সংলগ্ন কুচলাচাটি এলাকায় অবস্থিত সেই কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় জেলার অন্যতম এক মডেল স্কুল।
জেলার কুচলাচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সম্প্রতি সমগ্র শিক্ষা মিশনের উদ্যোগে জেলাব্যাপী যে ‘শিখন শিক্ষণ উপকরণ’ (TLM) প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে জেলার প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ‘প্রথম স্থান’ অধিকার করেছে এই স্কুল। নানা অভিনব উদ্যোগ, পড়াশোনার মান, ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতা-সক্রিয়তা সহ স্কুলের সার্বিক পরিকাঠামোর উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে এই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা (TIC) তনুশ্রী দাস-কে রাজ্য সরকারের তরফে ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয় ২০২০ সালে। ২০২২ সালে কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্বচ্ছ বিদ্যালয় পুরস্কার’ সম্মান অর্জন করে। ২০২৩ সালে রাজ্য সরকারের ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’-ও পায় এই স্কুল। স্কুলের প্রতিটি ক্লাসরুমেই রাখা আছে বিষয়ভিত্তিক অসংখ্য শিক্ষা উপকরণ বা টিচিং লার্নিং ম্যাটেরিয়াল। যা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে ছাত্রছাত্রীরাই তৈরি করেছে। ক্লাসরুমের সিলিং বা ছাদেও কারুকার্য।
তবে স্কুলের মধ্যে ব্যাঙ্ক কিংবা হাসপাতাল কেন? জানা গিয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের সংরক্ষণ করে রাখা এক, দুটো টাকা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে তারা। কখনও বাড়ির লোকেদের অসুস্থতায় ওষুধ কেনার জন্য কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে থাকে ছোট্ট ছোট্ট খুদেরা। তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের মানসিকতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের এই আয়োজন। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে বিছানো শয্যা কেন? বিদ্যালয়ে থাকাকালীন কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার প্রাথমিক চিকিৎসা করা যাবে এই বিদ্যালয়ে। তার জন্য ফার্স্ট এইড বক্স এবং এই শয্যা তৈরি করা।
শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়াশোনা করা নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সামাজিকতা নৈতিক কর্তব্য এবং একে অপরের প্রতি সাহায্যের মানসিকতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রান্তিক এলাকার এই বিদ্যালয়ের অভিনব আয়োজন। বিদ্যালয়ের এই বিশেষ ভাবনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সকলে।
রঞ্জন চন্দ
Kolkata [Calcutta],Kolkata,West Bengal