আর্ট থেরাপি: রঙতুলিতে চাপ মোকাবিলার শিল্পকৌশল

আর্ট থেরাপি: রঙতুলিতে চাপ মোকাবিলার শিল্পকৌশল

আপনার মাথাটা কি সারাদিনের চাপে ভারী হয়ে আছে? অফিসের টার্গেট, সংসারের দায়িত্ব, ট্রাফিক জ্যামের ক্লান্তি – যেন একটা অদৃশ্য শিকল আপনাকে বেঁধে রেখেছে। ক্লান্তির এই গহ্বর থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে পাচ্ছেন না? হয়তো বলবেন, “আমি তো আঁকতে জানি না!” কিন্তু জানেন কি, শিল্পের এই ভাষা বোঝার কোন প্রয়োজন নেই? শুধু রং, রেখা আর আপনার হাতের স্পর্শই হতে পারে মানসিক চাপ কমানোর সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ। আর্ট থেরাপি ফর স্ট্রেস শুধু একটি থেরাপি নয়, এটি হল আপনার অব্যক্ত অনুভূতিকে রঙ-তুলির মাধ্যমে মুক্ত করার এক অনন্য শিল্পকৌশল। বিশ্বজুড়ে মনোবিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন, ক্যানভাসে রং ছড়ানোর এই সহজ প্রক্রিয়াটিই মস্তিষ্কে তৈরি করে শান্তির রাসায়নিক, ভেঙে দেয় উদ্বেগের দেয়াল। ঢাকার ব্যস্ততম কর্পোরেট অফিস থেকে শুরু করে সিলেটের ছিমছাম গ্রামে – সৃজনশীলতার এই জাদুকরি স্পর্শ এখন সবার জন্যই খুলে দিচ্ছে চাপমুক্তির নতুন দরজা।

আর্ট থেরাপি: রঙতুলিতে চাপ মোকাবিলার শিল্পকৌশলআর্ট থেরাপি: রঙতুলিতে চাপ মোকাবিলার শিল্পকৌশল

আর্ট থেরাপি কী এবং কীভাবে এটি মানসিক চাপ কমায়?

আর্ট থেরাপি কোন শিল্প প্রতিযোগিতা নয়, এখানে দক্ষতারও কোন মূল্য নেই। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি যেখানে চিত্রাঙ্কন, মূর্তিশিল্প, কোলাজ বা অন্য কোন শিল্পমাধ্যম ব্যবহার করে ব্যক্তি তার অন্তর্নিহিত আবেগ, চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতাগুলোকে নিরাপদে প্রকাশ করেন। আর্ট থেরাপি ফর স্ট্রেস এর মূল উদ্দেশ্য হলো শিল্প সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানসিক ও শারীরিক চাপ প্রশমন।

  • মস্তিষ্কের রসায়নে পরিবর্তন: গবেষণা বলছে, সৃজনশীল কাজে লিপ্ত থাকলে মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং সেরোটোনিনের মতো ‘ফিল-গুড’ হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে। আমেরিকান আর্ট থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (AATA) এর মতে, শিল্পচর্চা কর্টিসল (চাপের হরমোন) এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সাহায্য করে।
  • অবচেতন মনের দরজা খোলা: কথায় প্রকাশ করতে পারা যায় না, এমন গভীর আঘাত বা জমে থাকা কষ্টও রং-রেখার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। এটি এক ধরনের নন-ভার্বাল থেরাপি, যেখানে ভাষার বাধা থাকে না।
  • মনোযোগের পুনঃকেন্দ্রীকরণ (Mindfulness): একটি ব্রাশ হাতে নিয়ে রঙের ছটা কাগজে ফেলার সময় আপনার সমস্ত মনোযোগ বর্তমান মুহূর্তে কেন্দ্রীভূত হয়। এই ‘ফ্লো স্টেট’ উদ্বেগ ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা বা অতীতের আক্ষেপ থেকে মনকে মুক্ত করে, গভীর শান্তি এনে দেয়।
  • নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি: যখন বাইরের জগতের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ কম মনে হয়, তখন ক্যানভাসে নিজের ইচ্ছামতো রং ছড়ানো, একটি মূর্তি গড়ে তোলা – এসব কাজ আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনে।

ডাঃ ফারহানা হক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক) বলছেন, “বাংলাদেশে দ্রুতগতির শহুরে জীবনে মানসিক চাপ মহামারীর আকার নিচ্ছে। অনেকেই কথ্য থেরাপিতে স্বস্তিবোধ করেন না বা লজ্জা পান। আর্ট থেরাপি ফর স্ট্রেস তখনই একটি নিরাপদ আশ্রয়। এটি সরাসরি আমাদের আবেগপ্রবণ মস্তিষ্ককে (লিম্বিক সিস্টেম) স্পর্শ করে, যুক্তির ফিল্টার ছাড়াই। আমি প্রতিদিন রোগীদের মধ্যে এর আশ্চর্য রূপান্তর দেখি – একটি ছবি কত গভীর নিরাময় এনে দিতে পারে, তা শুধু বিশ্বাস করলেই হয় না, দেখতে হয়।

ঘরে বসেই শুরু করুন: আর্ট থেরাপির সহজ কৌশলাবলি

আর্ট থেরাপিস্টের কাছে যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও আপনি নিজেই ঘরে বসে আর্ট থেরাপি ফর স্ট্রেস এর সুফল পেতে পারেন। মনে রাখুন, লক্ষ্য ‘সুন্দর কিছু বানানো’ নয়, বরং ‘মুক্তভাবে প্রকাশ করা’।

শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ

  • কাগজ: যেকোনো ধরনের – স্কেচবুক, পুরোনো খাতা, এমনকি প্যাকেটিং পেপারও চলবে।
  • রং: পেন্সিল কালার, জলরং, অ্যাক্রিলিক, প্যাস্টেল, মার্কার – যা হাতের কাছে আছে।
  • অন্যান্য: মোম, কাদামাটি, ম্যাগাজিন থেকে ছবি কাটার জন্য কাঁচি, আঠা।
  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: নিজের প্রতি কোমলতা ও খোলা মন।

চাপ কমানোর জন্য কার্যকরী আর্ট এক্সারসাইজ

  1. ‘আমার আবেগের রং’ (The Color of My Emotion):
    • বর্তমানে আপনার মনে যে আবেগটি সবচেয়ে প্রবল (যেমন: উদ্বেগ, ক্লান্তি, রাগ, বিষণ্নতা, শান্তি), তার জন্য একটি রং বেছে নিন।
    • চোখ বন্ধ করে সেই অনুভূতিটিকে অনুভব করুন।
    • চোখ খুলে বেছে নেওয়া রং দিয়ে পুরো কাগজটাকে ভরাট করুন – কীভাবে ভরাট করবেন, সেটা সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছা (জোরে জোরে রেখা টানা, আলতো করে রং ছড়ানো, আঙুল দিয়ে ছোঁয়া ইত্যাদি)।
    • লক্ষ্য করুন, রং করার পর আপনার সেই আবেগের তীব্রতায় কী পরিবর্তন আসলো?
  2. ‘চাপের গোলক’ (The Stress Balloon):
    • কাগজে একটি বড় বেলুনের ছবি আঁকুন বা কল্পনা করুন।
    • এই বেলুনের ভেতর সেই সমস্ত চিন্তা, উদ্বেগ বা পরিস্থিতি লিখুন বা ছবি আঁকুন যা আপনাকে চাপ দিচ্ছে।
    • এবার, কলম বা রং দিয়ে সেই বেলুনটি ‘ফাটিয়ে’ দিন – যেভাবে খুশি! কাটাকুটি করুন, জোরে জোরে ক্রস চিহ্ন দিন, রং লেপে ঢেকে দিন।
    • এই কর্মটি প্রতীকীভাবে আপনার চাপের উৎসগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অনুভূতি দেয়।
  3. ‘নিরাপদ জায়গা’ (My Safe Haven):
    • চোখ বন্ধ করে নিজের জন্য একটি সম্পূর্ণ নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও সুখকর জায়গার কথা কল্পনা করুন। এটি বাস্তব বা কাল্পনিক যেকোনো কিছু হতে পারে।
    • এই জায়গাটিকে কাগজে আনার চেষ্টা করুন – দৃশ্য, রং, অনুভূতি, এমনকি গন্ধ বা শব্দও রং বা প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করুন।
    • যখনই চাপ লাগবে, এই ছবিটির দিকে তাকান এবং নিজেকে সেই জায়গায় থাকার কথা মনে করুন।
  4. ম্যান্ডালা রং করা (Mandala Coloring):
    • ম্যান্ডালা হল জ্যামিতিক নকশার একটি বৃত্তাকার রূপ, প্রাচীনকাল থেকেই যার ধ্যান ও কেন্দ্রীভূত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
    • ইন্টারনেট থেকে সহজেই ম্যান্ডালার ছবি প্রিন্ট করে নিন (বা নিজেই সরল জ্যামিতিক আকার দিয়ে শুরু করুন)।
    • মন চায় যেমন রং, তেমনই করুন। কোন নিয়ম নেই। শুধু রং ছড়ানোর দিকে মন দিন।
    • এই পুনরাবৃত্তিমূলক কাজটি মস্তিষ্ককে শান্ত করে, হৃদস্পন্দন কমায়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা (আনিকা তাসনিম, বিপিও কর্মী, ঢাকা): “কোভিডের সময় একসাথে বাবা-মা হারানোর পর আমি এক ধরণের আবেশে আটকে গিয়েছিলাম। কথায় বলতে পারতাম না। একজন কাউন্সেলর আমাকে শুধু লাল ও কালো রং দিয়ে কাগজে যেকোন কিছু আঁকতে বললেন। প্রথমে এলোমেলো দাগ। ধীরে ধীরে সেগুলো রূপ নিল ঝড়, আগুন, কান্নার ফোঁটায়। প্রতিদিন কিছুক্ষণ আঁকতে আঁকতে মনে হচ্ছিল যেন বিষাক্ত কিছু বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। আজ আমি সুস্থ, কিন্তু এখনও স্ট্রেস ফিল করলেই রং তুলি নিয়ে বসে পড়ি। এটা আমার জীবনের রসদ হয়ে গেছে।”

আর্ট থেরাপির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি: তথ্য ও গবেষণা

আর্ট থেরাপি ফর স্ট্রেস শুধু একটা ধারণা নয়, এর পেছনে রয়েছে মজবুত বিজ্ঞান।

  • স্ট্রেস হরমোনে প্রভাব: জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান আর্ট থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় (২০২০) দেখা গেছে, মাত্র ৪৫ মিনিট সৃজনশীল শিল্পচর্চা (যেমন মৃৎশিল্প বা ফ্রি-হ্যান্ড ড্রয়িং) রক্তে কর্টিসলের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
  • ব্যথা ব্যবস্থাপনা: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (NIH) এর গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে আর্ট থেরাপি দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য সহায়ক হতে পারে, সম্ভবত এটি মস্তিষ্কের ব্যথা প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে কাজ করে।
  • ট্রমা থেরাপি: হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফ্রান্সেস ই. কাপলান বলেছেন, আর্ট থেরাপি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষভাবে কার্যকর, কারণ এটি তাদেরকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে আঘাতজনিত অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে কাজ করতে দেয়।
  • বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিকতা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় (২০২৩) দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যাদের পরীক্ষা সংক্রান্ত উদ্বেগ ছিল, তাদের একটি দল নিয়মিত আর্ট থেরাপি সেশনে অংশ নেওয়ার পর উদ্বেগ স্কেলে গড়ে ৩০% বেশি উন্নতি দেখিয়েছে কথ্য থেরাপি নেওয়া দলের তুলনায়।

কখন পেশাদার আর্ট থেরাপিস্টের সহায়তা নেবেন?

যদিও ঘরে বসে আর্ট করা উপকারী, কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষিত আর্ট থেরাপিস্ট এর সহায়তা অপরিহার্য:

  • গভীর মানসিক আঘাত (Trauma): শৈশবের ট্রমা, দুর্ব্যবহার, দুর্ঘটনা বা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা।
  • মেজর ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার: যখন দৈনন্দিন জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে।
  • জটিল শোক (Complicated Grief): প্রিয়জন হারানোর ব্যথা সময়ের সাথে কমার বদলে বাড়তে থাকলে।
  • দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা বা ব্যথা: ক্যান্সার, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার রোগীদের মানসিকভাবে সামলাতে।
  • বাচ্চাদের মানসিক সমস্যা: অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, আচরণগত সমস্যা বা স্কুলে মানিয়ে নিতে না পারা।

একজন রেজিস্টার্ড আর্ট থেরাপিস্ট (ATR) শুধু আপনার শিল্পকর্ম দেখেই নয়, সেইসাথে সেটি তৈরির প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতে এবং নিরাপদে আবেগ প্রকাশে সাহায্য করতে পারেন। বাংলাদেশে এখনও আনুষ্ঠানিক আর্ট থেরাপি ডিগ্রি সীমিত, তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু প্রাইভেট ক্লিনিক এবং কাউন্সেলিং সেন্টারে প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট পাওয়া যায়। মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর (মনোযেমন: মনন, মনোযোগ ফাউন্ডেশন) সাথে যোগাযোগ করে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।

আর্ট থেরাপিকে জীবনের অংশ করুন: টেকসই অভ্যাস গড়ে তোলা

আর্ট থেরাপি ফর স্ট্রেস এর সত্যিকারের সুফল পেতে একে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করা জরুরি।

  • অল্প সময়, নিয়মিত: প্রতিদিন ১৫-২০ মিনিটও যথেষ্ট। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় রাখুন (যেমন: ঘুমানোর আগে, সকালে চা/কফির সময়)।
  • ‘আর্ট জার্নাল’ তৈরি করুন: একটি স্কেচবুক শুধু আপনার শিল্পকর্মের নয়, আপনার অনুভূতির দিনলিপিও হয়ে উঠতে পারে।
  • গোষ্ঠীগত কার্যক্রম: বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে বসে একসাথে আঁকুন। আলোচনা না করলেও শুধু পাশাপাশি সৃজনশীল কাজ করাও সংযোগ ও স্বস্তি দিতে পারে।
  • কৃতিত্ব বিচার নয়: আপনার সৃষ্টির ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ হওয়ার দিকে নজর দেবেন না। লক্ষ্য করুন প্রক্রিয়াটি আপনাকে কেমন অনুভূতি দিচ্ছে।
  • বিভিন্ন মাধ্যম খুঁজে বের করুন: শুধু আঁকাই নয়, কাদামাটি, ফটোগ্রাফি, ফ্যাব্রিক আর্ট, এমনকি রান্নাও হতে পারে আপনার আর্ট থেরাপি!

বাংলাদেশে সহায়ক সম্পদ:

  • বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটি (BCPS): মনোবিদদের রেফারেল দিতে পারে। তাদের ওয়েবসাইট (যদি থাকে)
  • জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা: পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা।
  • অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: মনোস্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবিনার বা কর্মশালার আয়োজন করে এমন পেজ (যেমন: Mind Matters BD ফেসবুক পেজ)।

(কোনও শিরোনাম নেই – চূড়ান্ত অনুচ্ছেদ)
আর্ট থেরাপি ফর স্ট্রেস কেবলমাত্র একটি থেরাপিউটিক পদ্ধতি নয়; এটি হল নিজের সবচেয়ে গভীর, হয়তো কথায় অকথিত অনুভূতির সাথে সংযোগ স্থাপনের এক অন্তরঙ্গ যাত্রা। যখন শব্দ ব্যর্থ হয়, যখন ক্লান্তি গ্রাস করে, তখন রং-তুলি-কাগজই হয়ে ওঠে আপনার নিরাপদ আশ্রয়, আপনার কণ্ঠস্বর। এটি আপনাকে শেখায় যে চাপ বা ব্যথা থেকেই সৃষ্টিশীলতার জন্ম হতে পারে – যেমন মাটির তলায় চাপে কয়লা হীরক হয়ে ওঠে। আপনার হাতের মুঠোয় আছে চাপ কমানোর এই সহজ, সাশ্রয়ী, অথচ শক্তিশালী হাতিয়ার। আজই একটি কাগজ আর যা কিছু হাতের কাছে পান, তা নিয়ে বসে পড়ুন। আঁকুন না আঁকুন, রং ছড়ান, কাগজ কুচি করুন – নিজেকে প্রকাশ করার সেই অনির্বচনীয় মুহূর্তটির জাদু আপনাকে এনে দেবে এক অদেখা প্রশান্তি। শুরু করুন আজই – আপনার মনের কথা বলতে দিন রং আর রেখার ভাষায়।

জেনে রাখুন (FAQs)

১. আমি একদম আঁকতে পারি না, তবুও কি আর্ট থেরাপি আমার জন্য?
নিশ্চিতভাবে হ্যাঁ! আর্ট থেরাপির লক্ষ্য সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি করা নয়, বরং অনুভূতি প্রকাশের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানসিক স্বস্তি লাভ করা। এর জন্য কোন শৈল্পিক দক্ষতা বা পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। এটি আপনার নিজের জন্য, নিজের সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি নিরাপদ জায়গা।

২. বাচ্চাদের জন্য আর্ট থেরাপি কতটা উপকারী?
বাচ্চারা প্রায়শই তাদের অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করতে পারে না। আর্ট থেরাপি তাদের জন্য একটি প্রাকৃতিক ও শক্তিশালী মাধ্যম। এটি স্কুলে মানিয়ে নেওয়া, উদ্বেগ কমানো, আচরণগত সমস্যা কমানো, ট্রমা কাটিয়ে উঠতে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াতে দারুণভাবে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞ আর্ট থেরাপিস্টরা শিশুর ছবি ও খেলার ভেতর দিয়ে তাদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারেন।

৩. আর্ট থেরাপি কি ডিপ্রেশন বা সিরিয়াস অ্যাংজাইটি সারাতে পারে?
আর্ট থেরাপি এককভাবে গুরুতর ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের সম্পূর্ণ চিকিৎসা নাও হতে পারে, তবে এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর সহায়ক পদ্ধতি। এটি প্রচলিত থেরাপি (কাউন্সেলিং) বা ওষুধের (যদি প্রয়োজন হয়) সাথে সমন্বয় করে ব্যবহার করা যায়। এটি আবেগ প্রকাশ, আত্ম-সচেতনতা বাড়ানো এবং শান্ত করার কৌশল শেখাতে সাহায্য করে, যা সামগ্রিক চিকিৎসা পরিকল্পনার মূল্যবান অংশ।

৪. ঘরে বসে আর্ট থেরাপি চেষ্টা করলে কীভাবে বুঝব যে এটা কাজ করছে?
কাজ করছে কিনা, তা মূল্যায়নের সেরা উপায় হল নিজের দিকে খেয়াল করা। লক্ষ্য করুন:

  • আর্ট করার সময় বা পরে কি আপনি কিছুটা হালকা বা শান্ত বোধ করছেন?
  • কি ঘুম বা মনোযোগের ক্ষেত্রে সামান্য উন্নতি হয়েছে?
  • কি আপনি নিজের আবেগগুলোকে সামান্য হলেও বুঝতে বা মোকাবিলা করতে পারছেন ভালোভাবে?
  • কি এটি আপনাকে বর্তমান মুহূর্তে থাকতে সাহায্য করছে?
    সুফল ধীরে ধীরে আসতে পারে। নিয়মিত চর্চা এবং নিজের প্রতি ধৈর্য্য রাখাই গুরুত্বপূর্ণ।

৫. বাংলাদেশে কোথায় যোগ্য আর্ট থেরাপিস্ট পেতে পারি?
বাংলাদেশে আর্ট থেরাপির আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এখনও বিকাশমান। তবে, কিছু মনোবিদ (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট) বা কাউন্সেলর আর্ট-ভিত্তিক কৌশল ব্যবহার করেন থেরাপিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সেন্টার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বা মনোযেমন: মনন, সাইকোলজিক্যাল হেলথ ওয়েলনেস সেন্টার (PHWC) এর মতো বেসরকারি মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোতে যোগাযোগ করে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ফেসবুকে ‘আর্ট থেরাপি বাংলাদেশ’ বা ‘মেন্টাল হেলথ বাংলাদেশ’ লিখে সার্চ করেও তথ্য পেতে পারেন।

৬. আর্ট থেরাপির জন্য কি দামী উপকরণ কিনতে হবে?
মোটেও না! আর্ট থেরাপির সৌন্দর্য্য এর সহজলভ্যতার মধ্যে। পুরোনো খাতা বা পিছনের পাতা, সন্তানের অব্যবহৃত পেন্সিল কালার, কলিং কার্ডের উল্টো পিঠ, এমনকি মাটি বা বালি – সবই হতে পারে আপনার মাধ্যম। প্রয়োজন শুধু ইচ্ছা এবং নিজেকে প্রকাশের সাহস।

Scroll to Top