নগর স্বাস্থ্যসেবা উপেক্ষিত বাস্তবতা | চ্যানেল আই অনলাইন

নগর স্বাস্থ্যসেবা উপেক্ষিত বাস্তবতা | চ্যানেল আই অনলাইন

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

বাংলাদেশের নগর স্বাস্থ্যখাত যুগযুগান্তর ধরেই জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে উপেক্ষিত। দ্রুত নগরায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বেড়ে চললেও, এই খাতে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সমন্বয়ের অভাবে সেবার মান ও প্রাপ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন এপ্রিল ২০২৫ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব বাস্তবতা তুলে ধরা হলেও, নগর স্বাস্থ্যসেবাকে কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পদ্ধতি অনুচ্ছেদের ৫ম পয়েন্টে পৃষ্ঠা নং ১৪ তে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন কর্তৃক বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সহায়তায় পরিচালিত জনমত জরিপ দেশের স্বাস্থ্যসেবার করুণ চিত্র অনেকাংশে উঠে এলেও কমিশনের প্রস্তাবনায় জনমতের এই স্পষ্ট বার্তার যথাযথ প্রতিফলন দেখা যায় না। কমিশনের প্রতিবেদনের ১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লিখিত এক জনমত জরিপের উল্লেখ আছে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জনমানুষের গুরুত্বপূর্ণ মত উঠে এসেছে: ৯৭% মানুষ মনে করেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে হওয়া উচিত যেখানে ৯২% মানুষ স্থানীয় পর্যায়ে (ওয়ার্ড/ইউনিয়ন) স্বাস্থ্যকেন্দ্র বৃদ্ধির পক্ষে মতামত দিয়েছেন, যা সার্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা (ইউএইচসি) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহর এবং গ্রামাঞ্চল- ভিন্ন অবকাঠামোর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য হ্রাস এবং সেবার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে জনগণের এই দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে যুক্ত করা যেতে পারে, তা নীতিগতভাবে বিশ্লেষণ অত্যাবশ্যক।

কমিশনের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য সেবাদান ও ভৌত অবকাঠামো পরিচ্ছেদের ৩ নং এর ৩.১.৭.২ এ (পৃষ্ঠা নং ৫৬) বর্ণিত পৌর ও নগর এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিবর্তন সংঠন অংশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় ও সহায়তায় নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো তৈরি এবং প্রয়োজনীয় বেসরকারি অংশগ্রহণের ব্যাপারে উল্লেখ থাকলেও সুস্পষ্ট কৌশল বা কর্মপরিকল্পনা অনুপস্থিত। ৩.১.২৮ অনুচ্ছেদে (পৃষ্ঠা নং ৬১) বর্ণিত (১) নগর/পৌর এলাকায় নবনির্মিত পদে চিকিৎসক অপর্যাপ্ততা, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ৫ শয্যা বিশিষ্ট ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং থানায় প্রয়োজনীয় উপকরণ সংরক্ষণের নীতিমালা কার্যকর করার কথা বলা হলেও কোন সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। স্বাস্থ্যসেবা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা সংস্কারের লক্ষ্যে বিশদ প্রস্তাবনা পরিচ্ছেদের ৩ নং এর ৩.২ প্রেক্ষাপট অংশে পৃষ্ঠা নং ৭১ এ বাংলাদেশের নগরায়ন “পরিকল্পনাহীন, অসমন্বিত এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাবিহীন রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত” উল্লিখিত রয়েছে, যা পরিকল্পিত, অংশগ্রহণমূলক ও চাহিদা-ভিত্তিক ভৌগলিক ম্যাপিং -এর মাধ্যমে নির্ধারিত করার উদ্দেশ্যে আমাদের পথচলা এখন সময়ের দাবী। যেখানে নগরায়নের হার ৩.২৭%, দেশের প্রায় ৩১.৬৬% জনসংখ্যা শহরাঞ্চলে বাস করে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৫০ লাখে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে[1]। এ জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে পর্যাপ্ত বসবাসের জায়গার অভাবে জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত করুণ, বিশেষত শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কমিশনের প্রতিবেদনে নগর স্বাস্থ্যসেবার উদ্বেগকর তথ্য উঠে আসলেও সুস্পষ্ট কৌশল অনুপস্থিত। ২০২১ সালে প্রকাশিত আরবান হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, যেখানে শহর বা নগর এলাকায় ৬০% মানুষই নিকটবর্তী স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, শহর ও নগর এলাকায় ৫৩.৫% – ৭৪.৭% প্রসূতি মা প্রসবকালীন সেবার অপর্যাপ্ততা, নবজাতকের মৃত্যু প্রতি ১,০০০ জন্মে ২৭, পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি ১,০০০ জন্মে ৩৫-৪১ ও ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৩.৬% এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অপুষ্টির হার যথাক্রমে ২৫.৬% ও ৩৫.৯% ইত্যাদি দুর্দশার চিত্রের প্রতিচ্ছবি থাকলেও বাস্তবায়নের রূপরেখা অথবা কর্মপরিকল্পনা নেই[2]।

প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা নং ৭৩ বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার ভূমিকায় দ্বৈততা এবং স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব রয়েছে। ১৯৭৫ ও ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার আইন নগর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নির্ধারণ করলেও, বাস্তবে এই দায়িত্ব বাস্তবায়ন হয়নি। কমিশনের প্রতিবেদনও এই ব্যবস্থাগত ব্যর্থতার গভীরে যায়নি। প্রতিবেদনে উল্লিখিত সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে চালু হওয়া আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেক্টর প্রকল্প নগর স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি, উপরন্তু দাতানির্ভরতা স্থায়িত্বকে বাধাগ্রস্ত করে।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পৃষ্ঠা নং ৫৪, ৭৮ পুষ্টি বিষয়ে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বেশিরভাগই জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম, বিদ্যালয়ভিত্তিক উদ্যোগ এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলমূল ও সবজির প্রচার-প্রসারের ওপর কেন্দ্রীভূত। যেমন, বিদ্যালয়ে সবজির বাগান তৈরি, স্কু্ল ফিডিং-এ শাকসবজির অন্তর্ভুক্তি, ফাস্ট ফুড নিষিদ্ধকরণ ও পুষ্টিকর খাবার বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে উৎসাহ দেওয়া। তবে এই উদ্যোগগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের এবং দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। গুরুত্বপূর্ণভাবে, প্রতিবেদনটিতে মাতৃ ও শিশুপুষ্টি, অপুষ্টি ও ক্ষুদ্র পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির বিষয়ে কোনো গভীর বিশ্লেষণ বা টার্গেটেড হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা নেই। জাতীয় পুষ্টিনীতি, পুষ্টি মনিটরিং ব্যবস্থা, বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে পুষ্টি ইন্টিগ্রেশনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ অনুপস্থিত। এছাড়াও, নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিহীনতা, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব, এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যপ্রাপ্তির বৈষম্য এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু উপেক্ষিত রয়েছে। সব মিলিয়ে, প্রতিবেদনটিতে পুষ্টিকে একটি জীবনচক্রভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকার হিসেবে দেখা হয়নি, বরং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু পার্শ্ব-উদ্যোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, যা জাতীয় পর্যায়ে পুষ্টি উন্নয়নের জন্য অপর্যাপ্ত।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা নং ৫৪, ৮৭, ২৭৯ দুর্যোগ ও জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এলেও, উপস্থাপনাটি অগোছালো ও অপর্যাপ্ত বিশ্লেষণভিত্তিক। প্রতিবেদনে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে “ইমারজেন্সি হেলথ ফান্ড” গঠনের কথা বলা হলেও, কীভাবে এই ফান্ড পরিচালিত হবে, কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে—তা নিয়ে স্পষ্ট রূপরেখা অনুপস্থিত। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন এবং বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সামান্য কিছু উল্লেখ থাকলেও, এটি লিঙ্গভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চাহিদা নির্ধারণে তেমন সুসংগঠিত নয়। বিশেষ করে, প্রতিবেদনটিতে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী বা শিশুর মতো অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়নি। এছাড়া, নগর এলাকায় জলাবদ্ধতা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি (আরবান হিট আইল্যান্ড), বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং হাসপাতাল-ভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা চিহ্নিত করা হলেও, এগুলোর জন্য কোন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা কীভাবে সমন্বয় করবে তা স্পষ্ট নয়। উল্লেখযোগ্যভাবে, পরিবেশ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আইন ও গাইডলাইন বাস্তবায়নের দায়-দায়িত্ব বা নজরদারি কাঠামো নিয়েও পরিস্কার কিছু বলা হয়নি। শহরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গরম বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা, মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। প্রতিবেদনটি জলবায়ু-স্বাস্থ্য সংযোগ বা ক্লাইমেট-স্মার্ট হেলথ ইনফ্রাস্ট্রাকচারের প্রস্তাবনা দেয়নি। সর্বোপরি, দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও জনস্বাস্থ্য সংকটের আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্যখাতে ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স তৈরির সুসংহত রোডম্যাপ এই অধ্যায়ে অনুপস্থিত, যা একটি বড় সীমাবদ্ধতা।

বর্তমানে নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একটি সুসংহত কাঠামোর অভাবে ভুগছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার তুলনায় নগর ব্যবস্থায় কোনো স্বতন্ত্র ও কার্যকর মডেল গড়ে ওঠেনি। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর অধীনে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু থাকলেও, সেগুলোতে নেই পর্যাপ্ত সমন্বয় ও নীতিগত দিকনির্দেশনা। নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহের ভৌগোলিক মানচিত্র (জিওগ্রাফিক্যাল ম্যাপিং) তৈরি, এবং চলমান স্বাস্থ্যসেবা ইউনিটগুলোকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর জন্য পুনর্গঠন করা সময়ের দাবি। শহরের উচ্চবিত্তরা সহজেই বেসরকারি হাসপাতালের সেবা নিলেও, নিম্নআয়ের জনগণ সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভর করে, যা অতিরিক্ত চাপে ভুগছে। এ দরিদ্র দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী অনেক সময় বেসরকারি ক্লিনিক বা ওষুধের দোকানে নির্ভরশীল হয়। প্রতিবেদনটি এই অব্যবস্থাপনার কথা বললেও, বেসরকারি খাতকে কীভাবে রেগুলেট বা ইন্টিগ্রেট করা যায়, সে বিষয়ে কোনো বাস্তবসম্মত সুপারিশ দেয়নি। নগর এলাকার স্বাস্থ্যচিত্র বিশ্লেষণে পৃথক বা ডিস্যাগ্রিগেটেড ডেটা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু প্রতিবেদনটিতে নগর/গ্রামভিত্তিক পৃথক তথ্য বিশ্লেষণ সীমিত। জাতীয় স্তরে তথ্য ব্যবস্থায় নগর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উপাত্ত সংগ্রহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রস্তাবনা থাকা উচিত ছিল। এছাড়াও, আইডিএমসির সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্টে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যাটা ১৭ লাখ ৯১ হাজার এবং শীর্ষ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে পঞ্চম। নগরে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী ও বস্তিবাসীরা এক বিশাল অংশ, যাদের স্বাস্থ্য চাহিদা ভিন্ন ও সংকটাপন্ন। কমিশনের প্রতিবেদনটি তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা যথাযথভাবে তুলে ধরেনি। সর্বোপরি, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার প্রতিবেদনটি একটি সমন্বিত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলেও, এটি নগর স্বাস্থ্যব্যবস্থার বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ এবং স্থানীয় সরকারের ভূমিকা যথাযথভাবে উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের ২০২৫ সালের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে, বিশেষত নগর স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, দুর্যোগ ও জলবায়ু স্বাস্থ্যঝুঁকি, এবং স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বিবেচনায়, পর্যায়ক্রমিক স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।

স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ (০–১ বছর)

স্বল্পমেয়াদে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রশাসনিক ও কাঠামোগত সংহতি প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যে, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নগর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব, কর্তৃত্ব ও সম্পৃক্ততা স্পষ্ট করতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন গাইডলাইন প্রণয়ন জরুরি। একইসাথে, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার আওতাধীন সকল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি সমন্বিত তালিকা প্রস্তুত ও ভৌগোলিকভাবে ম্যাপিং শুরু করতে হবে, যাতে পরিকল্পনায় অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা প্রতিফলিত হয়। দ্বিতীয়ত, নগর স্বাস্থ্যসেবায় দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে “ইমারজেন্সি হেলথ ফান্ড” পরিচালনার জন্য একটি স্বচ্ছ গাইডলাইন ও বাজেট বরাদ্দ কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। একইসাথে প্রতিটি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা কিট ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী নিশ্চিত করে প্রাথমিক দুর্যোগ প্রস্তুতি কার্যকর করতে হবে। তৃতীয়ত, নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে লক্ষিত মা ও শিশুপুষ্টি কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন, যা নগর স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপকে জোরদার করবে। একইসাথে, নগরের খাদ্য পরিবেশ যাচাই করে কমদামি ও পুষ্টিকর খাবারের প্রাপ্যতা বাড়াতে মোবাইল ফলমূল ও সবজির বাজার চালুর একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। চতুর্থত, নগর ও গ্রামীণ স্বাস্থ্য উপাত্ত পৃথকভাবে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য পরিসংখ্যান ব্যুরো ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে একটি উন্নত ডেটা সংগ্রহ কাঠামো গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি নগর স্বাস্থ্যনীতির পরিকল্পনায় বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি করবে।

মধ্যমেয়াদি সুপারিশ (১–৩ বছর)

মধ্যমেয়াদে, নগর স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি একক সমন্বয়কারী দপ্তর, যেমন “আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার অথোরিটি’’ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এই দপ্তর নগর স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও তদারকির মূল কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করবে। একইভাবে, নারীবান্ধব সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনে অন্তত একটি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন। নগরে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকে মানসম্মত ও জবাবদিহিমূলক করতে একটি কার্যকর রেগুলেটরি মেকানিজম তৈরি করা প্রয়োজন, যা প্রাইভেট ক্লিনিক ও ফার্মেসিগুলোর মাননিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। একইসাথে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নাগরিক স্বাস্থ্য তথ্য রিপোর্টিংয়ের আওতায় আনা উচিত। জলবায়ু-স্বাস্থ্য সংযোগে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে “ক্লাইমেট স্মার্ট আরবান হেলথ’’ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন। এর আওতায় তাপ-সহনশীল স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জলাবদ্ধতা প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাঠামো বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী ও বস্তিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে মোবাইল হেলথ ইউনিট চালু করা উচিত। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সাবসিডিযুক্ত সেবা কিংবা হেলথ ভাউচার সিস্টেম চালু করাও একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ (৩–৫ বছর ও তদূর্ধ্ব)

দীর্ঘমেয়াদে, একটি জাতীয় “আরবান হেলথ পলিসি’’ প্রণয়ন ও তা সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাঠামোর (ইউএইচসি) সঙ্গে সমন্বয় করে নগর স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংহত করা আবশ্যক। একইসাথে, জাতীয় বাজেটে নগর স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ কোটা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে এ খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত হয়। স্থায়ী ও টেকসই পুষ্টি হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে জাতীয় পুষ্টিনীতি অনুসারে নগরভিত্তিক পুষ্টি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন করা জরুরি। এ লক্ষ্যে একটি নগর পুষ্টি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা (আরবান নিউট্রিশন সার্ভিল্যান্স সিস্টেম) চালু করা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনে ‘আরবান ইন্টিগ্রেটেড হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট সেল’ গঠন করা যেতে পারে, যা স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিরূপণ, প্রস্তুতি ও অভিযোজন, ওয়ান স্টপ হেলথ সার্ভিস পরিকল্পনা-বাস্তবায়ন করবে। একইসাথে, একটি নগর স্বাস্থ্য রেজিলিয়েন্স রোডম্যাপ তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অবশেষে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগর স্বাস্থ্য প্রশাসনে অধিক সক্ষম করে তুলতে তাদের জন্য দক্ষ জনবল, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সরকার আইন বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যকর মনিটরিং কাঠামো প্রণয়নও জরুরি।

(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Scroll to Top