বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের এক বছর: প্রতিশোধ নাকি পুনর্গঠন? | চ্যানেল আই অনলাইন

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের এক বছর: প্রতিশোধ নাকি পুনর্গঠন? | চ্যানেল আই অনলাইন

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

এক বছরের কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ রক্তাক্ত বিদ্রোহ, শাসনপরিবর্তন এবং উচ্চাশী সংস্কারের পথ অতিক্রম করেছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে এলেও দেশের রাজনীতিতে উত্তেজনা অব্যাহত, বিদেশ নীতিতে দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা, আর অর্থনীতিতে উন্নতির আড়ালে জমে আছে গভীর কাঠামোগত সংকট। এই সময়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে—বাংলাদেশ কি সত্যিই একটি নতুন সূচনা করতে পারবে, নাকি প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতি সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেবে?

২৬ জুন বৃহস্পতিবার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই বিষয়গুলো তুলে ধরে দ্য ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, জুলাই বিপ্লবের ১১ মাস পর, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও অস্থির। যদিও অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত রয়েছে—এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) মতে, জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা আগের আশঙ্কার চেয়ে অনেক ভালো। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, এবং মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশে এসেছে।

সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যাংকিং খাত থেকে অনিয়ম দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং পুরোনো সরকারের বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারেও কাজ করছে। ফলে আইএমএফ ও এডিবি থেকে মিলেছে বহু বিলিয়ন ডলারের ঋণ।

তবে এডিবির বিশ্লেষক চন্দন সাপকোটা বলছেন, এখন পর্যন্ত সরকার যেসব সংস্কার করেছে তা সহজ স্তরের—মূল কাঠামোগত সমস্যা যেমন কর্মসংস্থানের অভাব, অবকাঠামো দুর্বলতা, এবং পোশাক রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এখনও রয়ে গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক খাতে কিছু স্বস্তি এলেও, বিদেশ নীতিতে সরকারের অবস্থান প্রশ্ন তুলেছে। সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বললেও, ড. ইউনূস প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে চীন গিয়েছেন এবং কয়েকটি সামরিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি সই করেছেন। চীনা যুদ্ধবিমান জে১০সি ও জেএফ১৭ কেনার আলোচনা চলছে—যা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সংঘাতে ব্যবহৃত হয়েছে। জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির দিকে গেছে। বাংলাদেশি পণ্যের জন্য ভারত তার বিমানবন্দর ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করেছে, যা রপ্তানি খরচ বাড়াবে।

চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সহায়তা কমিয়েছে এবং ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে, যা ৯ জুলাই থেকে কার্যকর হতে পারে। এতে দেশের তৈরি পোশাক খাত বড় ধাক্কা খাবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—গণতন্ত্র কত দ্রুত এবং কতটা স্থায়ীভাবে ফিরবে? ড. ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বললেও, তার আগে জুলাই চার্টার নামে একটি চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করতে চান। তবে এতে কী থাকবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

এতে আরও বলা হয়, নিবন্ধিত দল এখন প্রায় ১৫০টি, যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নতুন দলটি হলো ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি), যা ছাত্র আন্দোলন থেকে গড়ে উঠেছে। তবে এক জরিপ বলছে, কেবল ৫ শতাংশ ভোটার এনসিপিকে ভোট দিতে চান। বরং পুরোনো দল বিএনপি ৪২ শতাংশ এবং জামায়াতে ইসলামি ৩২ শতাংশ ভোটারদের সমর্থন পাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের বিষয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও শক্তিশালী দলটি, এখন নিষিদ্ধ। মে মাসে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও আদালতের রায় এখনো হয়নি, এই নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘ হতে পারে। ফলে বহু ভোটার মনে করছেন, তাদের রাজনৈতিক পছন্দ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করেছেন, এখনো দেশের অর্ধেক জনগণ দলটির সঙ্গে সহানুভূতিশীল।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে, গত এক বছরে তাদের ২৪ জন কর্মী বা সমর্থক পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একে একতরফা দমননীতি বলে আখ্যা দিয়েছে এবং বলেছে, এটি আগের সরকারের বিরোধীদের দমন নীতির প্রতিফলন।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আইনি বিশেষজ্ঞ আরাফাত খান বলেন, স্থায়ী পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সবাইকে একত্রে নিয়ে চলা, প্রতিশোধ নয়। বাংলাদেশ এখন নেলসন ম্যান্ডেলা মুহূর্তের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

বাংলাদেশের সামনে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ রয়েছে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার। তবে প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং বিদেশ নীতিতে ভারসাম্যহীনতা যদি চলতেই থাকে, তাহলে এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।

Scroll to Top