আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো | চ্যানেল আই অনলাইন

আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো | চ্যানেল আই অনলাইন

মিয়ানমারের আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’। 

বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ আবার তাদের প্রতিবেদনের বক্তব্যের সমর্থনে বলেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম জোরদার করেছে তারা। এমনকি সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোয় যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্থাটি বলছে, পক্ষ দু’টি যুদ্ধে জড়ালে মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরও নষ্ট হবে। যার ফলে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ তো হবেই, সেইসঙ্গে নতুন করে আরও রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হতে পারে।

‘বাংলাদেশ/মিয়ানমার: রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র তৎপরতার ঝুঁকি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের শেষের দিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যরা রাখাইন রাজ্যের দখল নেয়। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আরও সংগঠিত হতে শুরু করে। নিজেদের শক্তি বাড়াতে এখন তারা নতুন করে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সমর্থিত আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ধর্মকে ব্যবহার করছে বলেও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায় কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা থামানো না গেলে সেটি বাংলাদেশদের জন্য “মারাত্মক ক্ষতি” বয়ে আনতে পারে বলেও সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।

তাদের দাবি সত্য হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও প্রকট হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।

রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে সংকট আরও বাড়বে

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন,  যুদ্ধ শুরু হলে তখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অনিরাপদ হয়ে পড়বে। আরাকান আর্মি সেখানে ঢুকে তাদের প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালাতে চাইবে। সব মিলিয়ে বিষয়টি দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকিতে পরিণত হবে।

যদিও বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ক্রাইসিস গ্রুপের অভিযোগগুলোকে অস্বীকার করছেন।  শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ক্যাম্পে সশস্ত্র তৎপরতা চলছে, ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে–– এগুলো অসত্য কথাবার্তা। উনারা যা বলছেন, সেগুলোর কোনো এভিডেন্স (প্রমাণ) নেই। আমরা সব সময় ক্যাম্পগুলো মনিটর করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। তাদের চোখের সামনে এগুলো ঘটবে, এটা অসম্ভব ব্যাপার।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গ্যানাইজেশনসহ (আরএসও) যত সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তারা সম্প্রতি একজোট হয়েছে।

যদিও অতীতে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোয় তারা নিজেদের মধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। কিন্তু আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাদের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ উত্তর রাখাইনের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, সেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকা উচিত বলে মনে করেন গোষ্ঠীগুলোর নেতারা।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির

সেজন্য নিজেদের মধ্যে হানাহানি থামিয়ে এখন একজোট হয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর নেতারা। তবে ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হওয়ায় কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাস্তবে সহিংসতাও আগের চেয়ে অনেকাংশে কমে গেছে। কিন্তু তাতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা থেমে নেই, বরং আগের চেয়ে আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে মাঝেমধ্যেই রক্তপাত ঘটানোয় আগে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিতো না সাধারণ রোহিঙ্গারা। ফলে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হতো তাদের। কিন্তু এখন গোষ্ঠীগুলো কৌশল বদল করেছে বলে জানাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। নতুন সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ‘অস্ত্র’ হিসেবে তারা এখন ধর্মকে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযানকে “অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ” হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।

এছাড়া রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা সরকার একটি সমঝোতা করার চেষ্টা করছে বলেও দাবি করা হয়েছে। যদিও ওই গোষ্ঠীগুলোই তার আগে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছিল।কিন্তু সমঝোতার পর রোহিঙ্গাদের গোষ্ঠীগুলোর একটি অংশ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সম্মত হয়। যদিও তখনও রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি।কিন্তু রাখাইন রাজ্যের দখল নেওয়ার পর উত্তর রাখাইনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।

এছাড়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির নেতাদের অনেকে এমন কিছু বিতর্কিত বক্তব্য দেন, যা দেখে রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে প্রভাবিত করে। এর মধ্যেই মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সমর্থিত আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচয়কে সামনে আনার কৌশল নিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতারা।

সংস্থাটির মতে, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। এরপরও গোষ্ঠীগুলো সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তেমনি মিয়ানমারেও রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব আরও বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকা ও তার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোরও উচিত শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা চালানো এবং নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করা।

সেইসঙ্গে, আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের যোগাযোগ আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন তারা। এছাড়া রাখাইন রাজ্যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য এবং মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য কাজ করাও দরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরাকান আর্মিকে উদ্দেশ্য করে ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, তাদের উচিত বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে প্রমাণ করা যে রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে তারা শাসনকাজ চালাতে পারে এবং মতপার্থক্য নিরসনে তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক।

Scroll to Top