রেজাল্ট খারাপ: দায়ভার কার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী নাকি প্রতিষ্ঠানের? | চ্যানেল আই অনলাইন

রেজাল্ট খারাপ: দায়ভার কার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী নাকি প্রতিষ্ঠানের? | চ্যানেল আই অনলাইন

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘Education is not the filling of a pail, but the lighting of a fire.’ এর অর্থ হলো—শিক্ষা শুধু মস্তিষ্কে তথ্য ঢেলে দেয়া নয়, বরং একজন মানুষের মধ্যে আগ্রহ, কৌতূহল এবং চিন্তার আলো জ্বালিয়ে দেয়ার বিষয়। একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে শিক্ষার মানের ওপর। এই ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গঠনে শিক্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে, যখন কোনো শিক্ষার্থীর রেজাল্ট খারাপ হয়, তখন সাধারণত দৃষ্টি যায় শিক্ষকের দিকে। প্রশ্ন ওঠে—এই ব্যর্থতার দায়ভার কি পুরোপুরিভাবে শিক্ষকের ওপর বর্তায়? নাকি অন্য কোনো উপাদানও এর জন্য দায়ী?

এই বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের নানা মত রয়েছে। ইউনিসেফ রিপোর্ট (২০২৩)-এ বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার্থীর রেজাল্ট খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ শিক্ষকের প্রশিক্ষণের অভাব, অপর্যাপ্ত শিক্ষার পরিবেশ এবং অভিভাবকের অসচেতনতা। শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান প্রদান করেন না, বরং শিক্ষার্থীর নৈতিকতা, আচরণ এবং চিন্তাশক্তিরও উন্নয়ন ঘটান। শিক্ষকের উৎসাহ, পদ্ধতিগত পাঠদান, ধৈর্য এবং শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক—সব কিছুই শিক্ষার্থীর রেজাল্টে প্রভাব ফেলে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, একজন শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব হলো প্রতিটি শিক্ষার্থীর আলাদা চাহিদা বোঝা এবং তার ভিত্তিতে পাঠদান করা। সবাইকে এক চোখে দেখা শিক্ষা নয়, এটি কেবল একটি প্রক্রিয়া।

তবে বাস্তবে দেখা যায়, অনেক সময় শিক্ষকরা সময়ের অভাবে অথবা অতিরিক্ত ক্লাস লোডের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যার দিকে নজর দিতে পারেন না, যার ফলে কিছু শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে। তবে শিক্ষক তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেও, চূড়ান্তভাবে একজন শিক্ষার্থীর সফলতা নির্ভর করে তার নিজস্ব মনোযোগ, অধ্যবসায় ও সময় ব্যবস্থাপনার উপর।

নোবেলজয়ী শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, একজন শিক্ষার্থী ব্যর্থ হলে শুধুমাত্র শিক্ষককে দায়ী করা অন্যায়। বরং একটি সমন্বিত ব্যবস্থার প্রয়োজন।

তবে এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর দিক থেকেও দায় রয়েছে। শিক্ষার্থীরাও একটি বড় ভূমিকা পালন করে তার রেজাল্টের ক্ষেত্রে। অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষার্থী মনোযোগী নয়, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কম, মোবাইল বা সামাজিক মাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করছে অথবা পড়াশোনার সঠিক কৌশল জানে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের এক গবেষণা অনুযায়ী, একাডেমিক ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ‘নিয়মিত পড়াশোনায় অনীহা’, ‘মোবাইল আসক্তি’ ও ‘পড়ালেখায় মনোযোগের অভাব’ অন্যতম।

মনোবিজ্ঞানী ড. রেশমা চৌধুরীর মতে, শুধু শিক্ষককে দোষ দিলে হবে না, শিক্ষার্থীর নিজের দায়িত্ববোধ এবং অধ্যবসায় না থাকলে ভালো ফলাফল সম্ভব নয়।

এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নিজের দায়ভারও অস্বীকার করা যায় না। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ, নিয়মিত অনুশীলন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ যদি শিক্ষার্থীর মধ্যে না থাকে, তাহলে সেখানেও ব্যর্থতার কারণ তৈরি হয়। তাছাড়া পারিবারিক সমস্যা, মানসিক চাপ বা স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা থাকলেও শিক্ষার্থীর রেজাল্টে প্রভাব পড়ে।

শুধু শিক্ষক বা শিক্ষার্থী নয়, একটি শিক্ষার পরিবেশও রেজাল্টের উপর বড় প্রভাব ফেলে। যেমন—বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, পর্যাপ্ত ক্লাসরুম না থাকা, টয়লেটের সমস্যা, নিরাপত্তাহীন পরিবেশ—এসব শিক্ষায় মনোযোগ ব্যাহত করে। অনেক সময় অভিভাবকরা শিক্ষার্থীর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেন না বা অযথা চাপ প্রয়োগ করেন, এতে শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। পাঠ্যসূচির ভার, পরীক্ষাভীতির সংস্কৃতি এবং প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভরশীলতাও শিক্ষার স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে।

কিছু বাস্তব উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। একটি স্কুলে দেখা যায়, একজন শিক্ষক অত্যন্ত আন্তরিকভাবে পড়ান, কিন্তু তার ক্লাসে ৫০ জন শিক্ষার্থী। তিনি প্রত্যেককে আলাদা করে সময় দিতে পারেন না, এতে কিছু শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে শিক্ষক দায়ী হলেও তা আংশিক। এখানে শ্রেণীকক্ষের অতিরিক্ত ভিড়, বিদ্যালয়ের নীতিমালার ত্রুটি ইত্যাদিও দায়ী। এছাড়া শহুরে ও গ্রামীণ শিক্ষার পার্থক্য যেমন—গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংখ্যা কম, সুযোগ-সুবিধা কম, ফলে শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করতে ব্যর্থ হয়। অথচ শিক্ষকরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, An investment in knowledge pays the best interest;

এর অর্থ হলো, জ্ঞান অর্জনের জন্য যে সময়, শ্রম বা অর্থ ব্যয় করা হয়, তার ফলাফল সব ধরনের বিনিয়োগের মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক। অথচ আমরা এই জায়গায় বিনিয়োগ করি কম।

এরপর দেখা যায়, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর সংখ্যা আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশে স্কুলপড়ুয়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য পাওয়া গেছে ২০২১ সালের ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ’ থেকে, যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত। এতে বলা হয়,

  • প্রতিবন্ধী শিশুদের সংখ্যা: ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ১.৭% শিশু অন্তত একটি ধরনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বসবাস করছে, যা ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত।
  •  ৬৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি।
  • ৩৫ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত।
  • মোট ৬০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না।
  • যেসব প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলে যাচ্ছে, তারা গড়ে বয়স অনুযায়ী দুই বছরের বেশি শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে রয়েছে।

এই তথ্যগুলো থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের একটি বড় অংশ এখনো শিক্ষার বাইরে রয়েছে এবং যারা স্কুলে যাচ্ছে, তারাও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে পড়াশোনা করতে গিয়ে তারা হিমশিম খায়। এছাড়াও অনেক শিক্ষার্থী শারীরিক বা মানসিক সমস্যায় ভোগে, যা শিক্ষক বুঝতে না পারলে ফল খারাপ হয়। তবে এটি শিক্ষক ও অভিভাবক উভয়ের সম্মিলিত সহযোগিতায় মোকাবেলা করা দরকার।

অন্যদিকে, একাধিক শিক্ষার্থীর রেজাল্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারা ভালো শিক্ষকের কাছেও পড়েও ভালো ফলাফল করতে পারে না, কারণ তারা নিজেরা অনুশীলন করে না বা নিয়মিত পড়াশোনা করে না। তখন দায় শিক্ষকের না হয়ে শিক্ষার্থীর ওপর বর্তায়।

এছাড়াও গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতির বাইরে আলভিন টফলারের একটি উক্তি তুলে ধরা যেতে পারে।

তিনি বলেছেন, The illiterate of the 21st century will not be those who cannot read and write, but those who cannot learn, unlearn, and relearn;

অর্থাৎ, ২১শ শতকের নিরক্ষর মানুষ তারা নয় যারা পড়তে বা লিখতে পারে না, বরং তারা যারা নতুন কিছু শিখতে পারে না, ভুল বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস ভুলে যেতে পারে না এবং নতুন করে শিখতে পারে না।

এই কথাটির মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, বর্তমান যুগে কেবল বই পড়া বা লেখা জানলেই কেউ শিক্ষিত হয় না। কারণ প্রযুক্তি, জ্ঞান, সমাজ—সব কিছু খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। তাই একজন মানুষকে সব সময় নতুন জিনিস শেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, পুরনো বা ভুল ধারণা ভুলে যেতে হবে এবং নতুনভাবে আবার শিখে নিতে হবে। যে এই তিনটি কাজ করতে পারে না, সে আসল নিরক্ষর।

শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের আসলে পদ্ধতি বদলাতে হবে। শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা বদলাতে হবে। এছাড়াও প্রযুক্তির যুগে শিক্ষকের ভূমিকা পরিবর্তিত হয়। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে নানা উৎস থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করতে পারে। ইউটিউব, গুগল, অনলাইন কোর্স ইত্যাদি শিক্ষায় বিপ্লব এনেছে। তাই এখন শিক্ষক একমাত্র জ্ঞানের উৎস নয়, বরং গাইড বা মেন্টর হিসেবে কাজ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষাবিদ ড. সাঈদা ইসলাম বলেন, শিক্ষকের কাজ এখন শুধু পড়ানো নয়, বরং শিক্ষার্থীর ভাবনা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা গড়ে তোলা।

ড. আনিসুজ্জামান (প্রয়াত) বলেন, শিক্ষকের দিক থেকে আন্তরিকতা না থাকলে শিক্ষার্থী উৎসাহ হারায়। তবে পরিবার ও সমাজও শিক্ষার্থীর উন্নয়নে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা দেখি, বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। একজন শিক্ষককে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী পড়াতে হয়, যা শিক্ষাদানের মানকে প্রভাবিত করে।

এই অবস্থায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি আলাদা মনোযোগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে, কিছু শিক্ষার্থীর রেজাল্ট খারাপ হতেই পারে।

তাহলে সমাধানের পথ কী?

  • শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়ন: প্রতি বছর শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে, যেন তারা আধুনিক পদ্ধতিতে ক্লাস নিতে পারেন।
  • শ্রেণীকক্ষ ছোট করা: প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫-৩০ এর বেশি না হলে শিক্ষক প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
  • পরিবার ও শিক্ষকের মধ্যে সমন্বয়: অভিভাবক ও শিক্ষক যেন নিয়মিত শিক্ষার্থীর অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেন।
  • শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং: মনোবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা প্রদান করা।
  • মাল্টিমিডিয়া ও ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার: পাঠদানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার্থীর আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করে।

পরিশেষে বলা যায়, একটি শিক্ষার্থীর রেজাল্ট খারাপ হলে দায় পুরোপুরিভাবে শিক্ষকের ওপর চাপিয়ে দেয়া যুক্তিযুক্ত নয়। এটি একটি সম্মিলিত চেষ্টার ফলাফল, যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র—সবার ভূমিকা রয়েছে।

শিক্ষক অবশ্যই প্রধান ভূমিকায় থাকেন, তবে সফলতা বা ব্যর্থতা কখনোই এককভাবে কারও হতে পারে না। তাই আমাদের উচিত দোষারোপ না করে, সমস্যার মূল খুঁজে বের করে সমাধানের পথ খুঁজে নেওয়া। শিক্ষার্থীর উন্নত ফলাফলের জন্য প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত, সহানুভূতিশীল এবং আধুনিক শিক্ষা পরিবেশ।

Scroll to Top