‘ছুটির ঘণ্টা’ নির্মাতার মরণোত্তর একুশে পদক নিয়ে মেয়ের ভাষ্য

‘ছুটির ঘণ্টা’ নির্মাতার মরণোত্তর একুশে পদক নিয়ে মেয়ের ভাষ্য

দুই বছর আগে কানাডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশের অন্যতম সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’সহ অসংখ্য সফল সিনেমার নির্মাতা আজিজুর রহমান। এরপর দেশে এনে তার মরদেহ জন্মস্থান বগুড়ার সান্তাহারে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওই সময়েই পরিবারের সদস্যরা আজিজুর রহমানের জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। এবারের একুশে পদকে আজিজুর রহমানের নাম প্রকাশ করায় পরিবার সন্তোষ প্রকাশ করেছে। বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছে। এক ফেসবুক পোস্টে এমনটা জানিয়েছেন আজিজুর রহমানের মেয়ে আলিয়া রহমান বিন্দি।

পরিচালক বাবা আজিজুর রহমান প্রসঙ্গে আলিয়া রহমান বলেন, ‘‘বাবা ছিলেন কাজপাগল একজন মানুষ। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তাকে দেখেছি কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে। তিনি কখনো টাকার জন্য কাজ করতেন না। তিনি সব সময় বলতেন, ‘আমি টাকার পেছনে ছুটব না, এত ভালো কাজ করব যে টাকা আমার পেছনে ছুটবে।’’ আলিয়ার মতে, হয়েছেও তা-ই। তার বাবা সেই সময়ে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের অন্যতম ব্যবসাসফল ছবিগুলো বানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

রাজ্জাক ও শাবানা জুটির কালজয়ী সিনেমা ‘ছুটির ঘণ্টা’র পোস্টার



আজিজুর রহমান একজন প্রকৃত মানুষ ছিলেন, যিনি অনেক পরিশ্রম করে সেই অবস্থানে পৌঁছেছেন উল্লেখ করে আলিয়া রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার বাবা একজন পরিপূর্ণ মানুষ, যিনি কি না আমাদের পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন। কখনো কোনো কারণে আমাদের ছোট হতে দেননি। খুবই সহজ–সরল ও নিরহংকার জীবন যাপন করতেন।’

বাবা আজিজুর রহমানের ছবি প্রসঙ্গে আলিয়া রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘বাবার প্রতিটা ছবি ছিল বক্তব্যধর্মী। তিনি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম ‘অশিক্ষিত’। যে ছবির মাধ্যমে জানাতে চেয়েছিলেন শিক্ষার কোনো বয়স নাই। তেমনি ‘ছুটির ঘণ্টা’য় সন্তানদের প্রতি জনসচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলেছেন। ‘রঙিন রূপবান’ বাংলাদেশ লোকগাথা নিয়ে বানানো। ‘ফুলেশ্বরী’ গ্রামবাংলার যাত্রাপালার গল্প। তার বেশির ভাগ ছবি গ্রামীণ পটভূমিতে বানানো। ‘জনতা এক্সপ্রেস’ এক ট্রেনচালক ও তার কাজের প্রতি দায়িত্ববোধের গল্প। এভাবেই তিনি এই জগতে হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তি। তিনি কখনো সমঝোতা করেননি, কখনো চাটুকারিতা করেননি এবং নেই কোনো স্ক্যান্ডালও।’’

বিজ্ঞাপন

রাজ্জাক ও অঞ্জনা জুটির সুপারহিট সিনেমা ‘অশিক্ষিত’র পোস্টার



সর্বশেষ আলিয়া রহমান লিখেছেন, ‘চলচ্চিত্রজগতে যারা কাজ করেন, তাদের অনেক শ্রম ও সময় দিতে হয়। বাবা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার সারা জীবন চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যয় করেছেন। ব্যতিক্রমধর্মী গল্প, নিরলস পরিশ্রম আর নতুন প্রযুক্তির ওপর গবেষণা তার ছবিগুলোকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো তাই তো আলোচনায় আছে যুগের পর যুগ। ব্যক্তিগত জীবনে বাবার কোনো আক্ষেপ ছিল না। বাবা নিজ হাতে তার পরিপূর্ণতার কথা লিখে রেখে গেছেন। কিন্তু সন্তান হিসেবে আক্ষেপ ছিল আমাদের। ৫২টি চলচ্চিত্রের নির্মাতা, যিনি একাধারে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, একজন অঙ্কন শিল্পী, প্রযোজক, কাহিনিকার, একজন পোস্টার মেকার, সেট ডিজাইনার, মেকআপ আর্টিস্ট। তিনি একজন ভার্সেটাইল ব্যক্তিত্বের মানুষ, অথচ একটা জাতীয় পুরস্কারের সম্মান এত দিন পাননি। পাননি আজীবন রাষ্ট্রীয় সম্মান। কিন্তু এবার আমার বাবা আজিজুর রহমান একুশে পদক পেয়েছেন। আমার বাবা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন। এটা আমাদের পরিবারের জন্য অত্যন্ত সম্মানের। আমরা বাবাকে এই সম্মানে ভূষিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ।’

স্ত্রীর সঙ্গে নির্মাতা আজিজুর রহমান



আজিজুর রহমান ১৯৩৯ সালের ১০ অক্টোবর বগুড়ার সান্তাহার রেলওয়ে জংশন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্থানীয় আহসানুল্লাহ ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি ও ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং চারুকলা আর্ট ইনস্টিটিউটে কমার্শিয়াল আর্টে ডিপ্লোমা করেন।

অনেক সফল চলচ্চিত্রের পরিচালক আজিজুর রহমান। ১৯৫৮ সালে ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে এহতেশামের সহকারী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ময়মনসিংহের লোককথা নিয়ে ‘সাইফুল মূলক বদিউজ্জামান’। মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। আজিজুর রহমান ৫২টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘অশিক্ষিত’, ‘মাটির ঘর’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘সাম্পানওয়ালা’, ‘ডাক্তার বাড়ি’, ‘গরমিল’ ও ‘সমাধান’।

নির্মাতা আজিজুর রহমান



Scroll to Top