ঢাকা, ০৪ ফেব্রুয়ারি – বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চুরির ঘটনার ৯ বছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি)। চুরির বছরই সামান্য অর্থ ফেরত পেলেও বেশিরভাগ অর্থ আজও ফেরত আসেনি। এমনকি রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মতিঝিল থানায় করা মামলার তদন্তকাজও দীর্ঘ ৯ বছরে শেষ করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ অবস্থায় মামলা তদন্তের দায়িত্ব নিতে চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক সূত্র বলছে, গত ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে সিআইডিকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে সিআইডি থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। সরকারের গঠিত টাস্কফোর্স জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন ৮০ বার পেছানো হয়েছে।
এদিকে, চুরির যাওয়া এই বিপুল অর্থ ফেরত পেতে ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলা পরিচালনায় আইনজীবী ও আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠানের ফি বাবদ মোটা অংকের অর্থ খরচ হলেও চলমান মামলার তেমন অগ্রগতি নেই। সাড়া নেই সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ ফেরত প্রক্রিয়ারও।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। দুর্বৃত্তরা সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা সরিয়ে নেয়।
অবশিষ্ট ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধারে বাংলাদেশের পক্ষে ফিলিপাইনের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ১২টি মামলা করে। সব মিলিয়ে চুরি যাওয়া মোট অর্থের মাত্র ৩৫ শতাংশ ফেরত এসেছে। ৬৫ শতাংশ অর্থই এখনো হাতের বাইরে
ওই সময়ে শ্রীলঙ্কায় নেওয়া ২ কোটি ডলার ফেরত পেয়েছিল বাংলাদেশ। ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টে নেওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ২০১৬ সালের নভেম্বরে দেশটির আদালতের নির্দেশে ক্যাসিনো মালিক কিম অং প্রায় দেড় কোটি ডলার ফেরত দেন।
বাকি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধারে বাংলাদেশের পক্ষে ফিলিপাইনের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ১২টি মামলা করে। সব মিলিয়ে চুরি হওয়া অর্থ থেকে ফেরত এসেছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। সে হিসাবে ৬৫ শতাংশ অর্থই এখনো হাতের বাইরে।
চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত এবং দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন সাউদার্ন জেলা আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ। মামলায় ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক, ক্যাসিনো মালিক কিম অংসহ ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করা হয়। ২০২০ সালের মার্চে ওই আদালত জানিয়ে দেন, মামলাটি তাদের এখতিয়ারাধীন নয়। এরপর একই বছরের ২৭ মে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট আদালতে মামলার আবেদন করা হয়।
বাংলাদেশের আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান কোজেন ও’কনর বিবাদীদের নোটিশ দেয়। পরে আরসিবিসি, অভিযুক্ত ব্যক্তি লরেঞ্জ ভি টান, রাউল টান, সোলায়ের ক্যাসিনো, ইস্টার্ন হাওয়ায়ে এবং কিম অং যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ‘মোশন টু ডিসমিস’ বা মামলাটি না চালানোর অনুরোধ জানিয়ে আবেদন করেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিত ২০২১ সালের ১৪ জুলাই ও একই বছরের ১৪ অক্টোবর শুনানি হয় এবং ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল আংশিক রায় দেন আদালত।
২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারি ছয় বিবাদীর ‘মোশন টু ডিসমিস’ বা মামলা না চালানোর আবেদন খারিজ করে দেন নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্ট। পাশাপাশি একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আরসিবিসিসহ অন্য বিবাদীদের মধ্যস্থতার নির্দেশ দেন স্টেট আদালত। তবে সমঝোতায় ফিলিপাইনের সাড়া না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেও পরে কোনো শুনানি হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ফিলিপাইন থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্থ ফেরত না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সমঝোতায় অর্থ আদায়ের রায় দেন আদালত।
ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি সমঝোতার জন্য ফিলিপাইনে যায় বাংলাদেশের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল। তবে সমঝোতায় সাড়া মেলেনি, দেশটির আদালত থেকেও কোনো রায় হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেও অগ্রগতি নেই। সব মিলিয়ে চুরি যাওয়া অর্থের বিপুল অংশ ফেরত পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
এদিকে, বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল নির্ধারণে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের গঠিত টাস্কফোর্স মন্তব্য করেছে, আন্তর্জাতিক সাইবার হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৬৭৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর বা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। চুরির ঘটনায় তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার কথাও বলা হয়েছে।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন ৮০ বার পেছানো হয়।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মতিঝিল থানায় যে মামলা হয়েছিল, তার তদন্ত ৯ বছরেও শেষ করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এখন মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব চাইছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
চুরির অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র এবং ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চুরির ঘটনার মামলা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে মামলা চলছে, অগ্রগতিও আছে। চলমান মামলা ও সমঝোতার মাধ্যমে ইতিবাচক দিক আসবে বলে আশা করছি।’
সূত্র: জাগো নিউজ
এনএন/ ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫