জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কার্য পরিধি ও জনগণের প্রত্যাশা | চ্যানেল আই অনলাইন

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কার্য পরিধি ও জনগণের প্রত্যাশা | চ্যানেল আই অনলাইন

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

জনপ্রশাসন কী এই নিয়ে আমাদের ধারণার অস্পষ্টতা রয়েছে। আমরা জনপ্রশাসন বলতে বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয় মনে করে থাকি। জনপ্রশাসন কোন নির্দিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। এর ব্যাপ্তি অত্যন্ত ব্যাপক।

সুনির্দিষ্টভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী (১৯৭৮) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একজন পথিকৃৎ হারবার্ট এ সাইমন প্রশাসনকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন, বৃহত্তর অর্থে প্রশাসন বলতে লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে সংগঠিত সহযোগিতাপূর্ণ গোষ্ঠী ক্রিয়াকে বোঝায়।

সে অনুযায়ী এই প্রশাসনের একটি বিশেষ ক্ষেত্র, যা সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কযুক্ত সব লক্ষ্য পূরণের কর্মপ্রচেষ্টাকে জনপ্রশাসন বলে অভিহিত করা যায়। এই প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় পরিকল্পনা গ্রহণ থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও জবাবদিহিতাসহ সার্বিক কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। অবশ্যই জনপ্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু জনগণ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিংবা সেবা সরবরাহকারী প্রজাতন্ত্রী কর্মচারীগণ নয়।

বিগত বছরগুলোতে জনসাধারণ যে সব বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, সেসব বিষয় মাথায় রেখেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণে      ৫ আগস্ট উত্তর বাংলাদেশে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে।

GOVT

গত ২৪ অক্টোবর ২০২৪ এ প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১১ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জনমুখী, জবাবদিহিমুলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলিবার লক্ষ্যে প্রশাসন সংস্থার কমিশন নামে কমিশন গঠন করিয়াছে।

অর্থাৎ এই কমিটির পরিধি হচ্ছে চারটি-জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা সৃষ্টির জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কার্যকর ও প্রভাব বিস্তার করে এমন সব সুপারিশ দেবে।

প্রায় দুই মাস পর ১৮ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সংবাদ সম্মেলনে তাদের খসড়া প্রস্তাবের একটি রূপরেখা দেয়। যা ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন একগুচ্ছ প্রস্তাব এবং সুপারিশ করতে যাচ্ছে -এর মধ্যে কুমিল্লা-ফরিদপুর বিভাগ সৃষ্টি, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ক্যাডার সার্ভিস থেকে পৃথককরণ, অন্য ক্যাডারগুলো নিয়ে পাঁচটি গুচ্ছ করারও সুপারিশ দেবে কমিশন। কমিশন প্রধান বলেন, ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে একটা স্পেশালাইজেশন আসবে।

পরীক্ষা ছাড়া সিভিল সার্ভিসের উপসচিব এবং যুগ্ম-সচিব পর্যায়ে কেউ পদোন্নতি পাবেন না বলে সরকারকে সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। আরো বলা হয় যে সরকারি চাকরিতে নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল ও উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাদের নেয়ার সুপারিশ দেয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রস্তাবগুলো প্রজ্ঞাপন অনুসারে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে প্রদত্ত মূল লক্ষ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। এগুলো অধিকাংশই কাঠামোগত। এই কাঠামোগত পরিবর্তন জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসন কীভাবে গড়ে তুলবে সেই প্রশ্ন রয়ে যায়।

এই চার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণগত ও কর্ম সম্পাদনে পদ্ধতিগত পরিবর্তন জরুরি। উদাহরণস্বরূপ কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে নতুন বিভাগ করা হচ্ছে, যা এই অঞ্চলের জনগনের প্রত্যাশা। তবে অন্য প্রস্তাব, যেমন কাঠামোগত সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ ক্যাডারসমূহের মধ্যে অসন্তোষ ও দ্বন্দ্ব আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে।

ইতোমধ্যেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করেছে। যে বৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে, তাও প্রকৃতপক্ষে কতখানি বৈষম্য তা তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষণাপূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।

প্রকৃতপক্ষে আইন, বিধি-বিধান এবং প্রতিটি ক্যাডারের সুযোগ-সুবিধা বিচার বিশ্লেষণ না করে শুধু বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের দাবি দাওয়ার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আত্মঘাতী হতে পারে। বিভিন্ন সময়ে প্রতিটি ক্যাডারকে তার কাজের প্রকৃতি ও ধরনসহ নানা বিবেচনায় বিভিন্ন রকমের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

এ ধরনের সুযোগ প্রদানের নানা প্রেক্ষাপট রয়েছে। জানা যায় যে, বিসিএস (শিক্ষা) ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতি করে থাকে, বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) কর্মকর্তাদের মোবাইল কোর্টে জব্দ মালামালের ৩০ শতাংশ রিওয়ার্ড হিসেবে দেয়া হয়, বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারদের সরকারি দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিস, এনজিও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে কাজ করার সুযোগ রয়েছে, বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডাররা প্যারালাল হিসেবে ৬ মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে শান্তি মিশনসহ বিভিন্ন সামরিক-অসামরিক ক্ষেত্রে প্রেষণে যেতে পারেন, বিসিএস (আনসার ও পুলিশ) ক্যাডারদের রেশন, অর্ডারলি, ঝুঁকিভাতা ও ওভারটাইম বেনিফিট রয়েছে, বিসিএস (ফরেন) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সরকার নির্ধারিত বেতন ভাতার বাইরে স্ত্রী সন্তানদের বিদেশে অবস্থানকালীন কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। ফলে আন্তঃ ক্যাডার বৈষম্যের বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে কতখানি বৈষম্য তা বিবেচনা করা প্রয়োজন।

প্রশাসন ক্যাডার প্রকৃতপক্ষে মূল বা আদি ক্যাডার। এ ক্যাডারের কাজের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। আইন প্রণয়ন, নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা গ্রহণ, প্রকল্প প্রণয়ন বাস্তবায়নসহ প্রশাসনের সব বিষয়ে মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ক্যাডারে উল্লেখিত সুবিধাগুলো নেই।

ক্যাডারভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের সুবিধা বা পদায়নকে বৈষম্য হিসেবে বিবেচনা করে সমতা সৃষ্টি করার উদ্যোগে ক্যাডারদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাডারের কাজের ধরন, গুরুত্ব ও যোগ্যতা বিবেচনা না করে এ সুপারিশ বুমেরাং হিসেবে দেখা দিয়েছে।

কমিশনের মুল লক্ষ্যকে সামনে রেখে জনমুখী, জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ প্রশাসনের সুপারিশ করা প্রয়োজন। এই মূল উদ্দেশ্য জনগণকে সেবা প্রদান। জনমুখী প্রশাসন বলতে আমরা সাধারণত বুঝি এমন একটি প্রশাসন ব্যবস্থা এখানে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র থাকবে জনসেবা।

সেবা পেতে জনগণকে যেন হয়রানির মুখে পড়তে না হয় এবং সেবাদান প্রক্রিয়া সহজ করতে আইন ও বিধি-বিধানের সংস্কার প্রয়োজন। সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে যে কয়টি বিষয়ে জনগণ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মুখে পড়ে সেগুলোকে সামনে রেখে সংস্কারের প্রস্তাব করা জরুরি। বিভিন্ন পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পথ নিশ্চিত করা।

প্রতিটি দপ্তরে জবাবদিহিতা প্রচলিত বিধানকে আরও শক্তিশালী করে। দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রদান করা। প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত নিরপেক্ষ করার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি কর্মচারীদের সুবিধা প্রদান এর মূল উদ্দেশ্য নয়।

পরিশেষে বলতে চাই, সংস্কার কোন সাময়িক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত নয়। একটি নিয়মিত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের ধারাবাহিকভাবে সংস্কার কাজ পরিচালনা করা উচিত।

তিন মাসে একটি সংস্কার কমিশন কাজ করে প্রতিবেদন প্রদানের মাধ্যমে প্রশাসনের সব সমস্যা সমাধান করা অথবা কোন গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা আদৌ সম্ভব কিনা তা ভাবা প্রয়োজন।

(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Shoroter Joba

Scroll to Top