জুমবাংলা ডেস্ক : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা মশা নিধনে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। বরং ডেঙ্গু রোগী যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মৃত্যুর হার। একই সঙ্গে বাড়ছে অন্যান্য মশার উপদ্রব। এমন প্রেক্ষাপটে মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশকের কার্যকারিতা ও মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তদারকির বিষয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। কালের কণ্ঠের করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশকে কার্যকরী উপাদান নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকলে সুফল পাওয়া যেত। যেহেতু সুফল মিলছে না, তাই এই কীটনাশক কীটতত্ত্ববিদদের উপস্থিতিতে ল্যাবে পরীক্ষা ও মান যাচাই করতে হবে। তৃতীয় পক্ষ থেকে আবার মনিটরিংয়েরও তাগিদ তাঁদের। দুই সিটি কর্তৃপক্ষ বলছে, মশা নিধনে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বাকি নেই।
মশা নিধনে দুই সিটিতে বরাদ্দ
দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে দুই সিটিতে মশা নিধনে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫৪ কোটি টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে (ডিএসসিসি) ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ ৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় রাখা হয়।
মশা নিধনে চলতি অর্থবছরে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ ঢাকা উত্তর সিটিতে (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। গত ১৩ বছরে ঢাকার মশা নিধনের নানা পদক্ষেপের পেছনে খরচ হয়েছে এক হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।
যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সিটি করপোরেশন
মশা নিধনে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে দুই সিটি। ব্যবহৃত কীটনাশকের মান যাচাই ও তদারকি কার্যক্রম জোরদারে করণীয় নির্ধারণে গত মাসের শেষ দিকে ডিএনসিসি বিশেষজ্ঞ কমিটির সভা হয়। সেখানে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মাঠ পর্যায়ে ডেঙ্গুসংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিংয়ে ডিএনসিসির ১০টি টিম গঠন করা হয়। রাজউক থেকে প্রায় তিন হাজার ৩০০টি নির্মীয়মান বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে অভিযান পরিচালনা করা হবে। অ্যাডভোকেসি সভা করা হবে নার্সারি মালিক, স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে।
অল্প সময়ে অধিক এলাকায় কীটনাশক প্রয়োগে আধুনিক প্রযুক্তির বাফেলো টারবাইন মেশিন ক্রয় এবং বছরব্যাপী মশক নিধন কার্যক্রমে ব্যবহারে পর্যাপ্ত কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি মজুদ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
উভয় করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ও টেকসই সমাধানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে গঠিত ছয় সদস্যের দুটি পৃথক বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে মশাবাহিত রোগের ওপর একটি পৃথক জরিপ পরিচালনার পাশাপাশি কীটনাশকের মানসম্মত ডোজ ব্যবহার নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছেন।
ডিএসসিসির তথ্য কর্মকর্তা জোবায়ের হোসেন বলেন, মশক নিধন কর্মীরা ঠিক সময়ে নির্দিষ্ট এলাকায় কীটনাশক স্প্রে করছেন কি না, তা মনিটর করা হচ্ছে। তাঁদের কার্যক্রম লাইভ করা হচ্ছে এবং অফিসে থেকে তা কর্মকর্তা মনিটর করছেন।
আছে গাফিলতির অভিযোগ
মশার উৎস নির্মূলে মশক নিধন কর্মীদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে ঢাকাবাসীর। রূপনগরের বাসিন্দা ইয়াসিন আলী বলেন, মশা নিধনে কর্মীদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। তাঁরা নিয়মিত আসছেন না। কেন আসছেন না, এ বিষয়ে মশক নিধন কর্মীদের জবাবদিহির আওতায় আনার তাগিদ দেন তিনি।
মিরপুরের বাসিন্দা কোরাইশ রেজা বলেন, রূপনগর খালটি বদ্ধ হয়ে আছে। পানি চলাচল করছে না। কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির এই খাল এখন মশার দখলে। এ ছাড়া দুর্গন্ধে এলাকায় থাকা দায়। বছরের পর বছর এই অবস্থা চলছে। এগুলোর পরিচ্ছন্নতার জন্য সিটি করপোরেশনকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও লাভ হয়নি।
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. মফিজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, খালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য দুটি ফ্লটিং যন্ত্র ক্রয় করা হয়েছে। এটি বর্তমানে রামপুরায় কাজ করছে। কাজ শেষ হলে এটি মিরপুরে নিয়ে আসা হবে।
কীটতত্ত্ববিদরা যা বলছেন
কীটনাশক পরীক্ষার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার দুই সিটিতে এডিস মশা নিধনে অ্যাডাল্টিসাইড ও ম্যালাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। লার্ভিসাইড এডিস মশার ক্ষেত্রে টেমিফস লিকুইড ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া লার্ভা নষ্ট করতে ম্যালেরিয়া ওয়েল-বি, নোভালুরন ট্যাবলেট ব্যবহার করা হচ্ছে।
ডিএনসিসির মশক নিধন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে আমাদের মশা নিধনে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। আমার প্রশ্ন, তাহলে কীটনাশকে কেন কাজ করছে না? আমাদের সংশয়ের জায়গাটি হলো, এই ওষুধের মান ঠিক আছে কি না। এ জন্য আমাদের উপস্থিতিতে ল্যাবে এই কীটনাশকের মান পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছি। ওষুধের মান ঠিক থাকলে এবং সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে এত মশা বাড়ত না।’
এই কীটতত্ত্ববিদ মনে করেন, মনিটরিং ব্যবস্থায়ও গাফিলতি আছে। যাঁরা মনিটর করছেন, তাঁদের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য পৃথক টিম থাকা দরকার। এ ছাড়া মনিটরিংয়ের কাজে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে হবে। একদল শিক্ষার্থীর মনিটরিংয়ের পর আরেকদল গিয়ে তা মনিটর করতে হবে, যাতে মনিটরিংয়ের কার্যক্রমে কোনো ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ না থাকে।
তিনি বলেন, যেখানে মশা বা লার্ভা বেশি পাওয়া যাচ্ছে, তার আশপাশের এলাকার মানুষকে সচেতন করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় কর্মশালার আয়োজন করতে হবে, যাতে স্থানীয়রা সচেতন হয়।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, মশা নিধনে এমন কোনো পদক্ষেপ নেই, যা নেওয়া হয়নি। সব ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের এই মুহূর্তে করণীয় আর কিছু নেই। তবে মশক নিধন কর্মীরা সঠিক সময়ে সঠিকভাবে কীটনাশক স্প্রে করছেন কি না এবং তা ভালোভাবে মনিটরিং হচ্ছে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ডিএনসিসির এক হাজার ১০০ মশক নিধন কর্মী রয়েছেন, যাঁরা প্রতিদিন কাজ করছেন বলে তিনি জানান। কীটনাশকের মান নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ল্যাবে পরীক্ষা করিয়েছি। দেখা গেছে মান ঠিক আছে।’
ডিএনসিসির এই প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এলাকাভিত্তিক ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যার তথ্যে কিছুটা অসংগতি রয়েছে। আমরা প্রতিটি ডেঙ্গু রোগীর কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছি এবং সে আলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।’
বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষকেরা চিন্তার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছেন