কণ্ঠরোধের কানুন ভাঙার প্রত্যয় | চ্যানেল আই অনলাইন

কণ্ঠরোধের কানুন ভাঙার প্রত্যয় | চ্যানেল আই অনলাইন

কণ্ঠ ছেড়ে গান গেয়ে, কণ্ঠরোধের সব কালাকানুন ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে শুরু হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা। 

উৎসবের প্রথম দিন শুক্রবার (৮ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় জাতীয় পর্যায়ের গণসংগীত প্রতিযোগিতা। জেলা পর্যায় শেষে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হয়ে সারাদেশ থেকে আসা প্রায় তিনশ’ শিল্পী দিনভর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তিনটি একক এবং একটি দলীয়- মোট চারটি বিভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগীরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতীয় সংগীতের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রথীন্দ্রনাথ রায়। সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান।

এসময় জাতীয় সংগীত ও সংগঠন সংগীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এরপর রথীন্দ্রনাথ রায় উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করার সাথে সাথেই ঢাকা-ঢোলের বাদনে নৃত্যের তালে তালে উল্লাসে মাতেন সারাদেশ থেকে আসা উদীচীর শিল্পী-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ। বিকাল পৌনে ৬টার দিকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন উদ্বোধক এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা। উদ্বাধক এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান উদীচী কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা। ফুল, উপহার ও উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা।

Reneta April 2023

উদীচীর সহ-সভাপতি এবং দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক মাহমুদ সেলিম-এর স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী আলোচনা পর্ব। উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান-এর সভাপতিত্বে এ পর্বে আরো বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সায়েম রানা এবং উৎসবের উদ্বোধক রথীন্দ্রনাথ রায়।

স্বাগত বক্তব্যে মাহমুদ সেলিম বলেন, গণসংগীতের প্রচার, প্রসার এবং সংগীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে গণসংগীতকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্মদিন ২৮ মার্চকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে উদীচী। সব জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গণসংগীত প্রতিযোগিতার বিজয়ীরা জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তিনটি একক এবং একটি দলীয়- মোট চারটি বিভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগীরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এবার ৫০টি জেলা এবং ৯টি বিভাগে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৮০ জন একক শিল্পী এবং ১৭টি দল মিলিয়ে প্রায় তিনশ’ শিল্পী জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। উদীচী মনে করে, সকলের যুথবদ্ধ প্রয়াসে গণসঙ্গীতের যেমন প্রসার ঘটবে, শিল্পীরা উদ্বুদ্ধ হবে এই গান গাইতে, তেমনি গণমানুষের শোষণ বঞ্চনা, পাওয়া না পাওয়া সুখ দুঃখ সুরের ললিত বাণী হয়ে ব্যাপ্ত হবে চারিদিকে।

উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকারসম্পন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গান-নাচ-নাটক-কবিতা-চলচ্চিত্রের মতো সৃজনশীল মাধ্যমকে হাতিয়ার করে সমাজের নানা অসঙ্গতি, শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছে উদীচী। প্রাথমিক অবস্থায় একটি গানের দল হিসেবে যাত্রা শুরু করা উদীচী, চারণ শিল্পীদের মতো কণ্ঠে গণসংগীত নিয়ে, মানুষের মুক্তির জন্য, ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সুরের মাধুর্যে অসুর নিধনের ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম এবং গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনসহ সাধারণ জনগণের যেকোন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অন্যতম অনুপ্রেরণা রেখেছে গণসংগীত।

তিনি আরো বলেন, অদ্ভুত এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি বিরাজ করছে আমাদের দেশে। নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটবাজি ও অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের দাদাগিরির সুযোগ তৈরি করে দেয়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি খাতে অচলাবস্থা, মুক্ত ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথ দিনদিন রুদ্ধ হওয়াসহ অসংখ্য বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ দেশবাসী। অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হলেও মানুষের মানবিক ঋদ্ধির দিকে কারো নজর নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণকারী সাইবার নিরাপত্তা আইন বা অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিলের মতো একের পর এক আইন-কানুন প্রণয়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এ অচলাবস্থা নিরসন এবং দেশকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামিল হতে গণসংগীতের সুরে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে চায় উদীচী। আর সেজন্যই এবারের উৎসবের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে- “কণ্ঠরোধের কানুন ভেঙে, কণ্ঠ ছেড়ে গান ধরেছি”।

শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সায়েম রানা বলেন, গণসংগীত সবসময়ই বর্তমান কালকে সঠিকভাবে উন্মোচন করে। সমাজের নানা অসঙ্গতি, অসাম্য, শোষণ-বঞ্চনার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলাসহ এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে গণসংগীত। তাই, বর্তমান কালকে ধারণ করে জনগণের মুক্তির সার্বিক চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাই গণসংগীতের কাজ। উদীচীর গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতায় বেশ কিছু নতুন গান পরিবেশিত হয়েছে যা বর্তমান সময়কে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলে।

আলোচনা পর্ব শেষে উদীচীর গণসংগীতের স্বরলিপির বই “দ্রোহের গান”-এর মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। উদীচীর কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগের উদ্যোগে প্রকাশিত বইটিতে স্থান পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন সেন, মাহমুদ সেলিম, প্রবীর সরদারসহ বিভিন্ন জনের লেখা ও সুর করা ২২টি উল্লেখযোগ্য গণসংগীত। এসব গানের স্বরলিপি তৈরি করেছেন মাহমুদ সেলিম এবং পূর্ণচন্দ্র মণ্ডল।

গণসংগীতের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের পর সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয় উৎসবের উদ্বোধনী পরিবেশনা। এ পরিবেশনায় বর্তমান সময়ে দেশের নানা অসাম্য, শোষণ-বঞ্চনা ও নৈরাজ্যের চিত্র তুলে ধরেন উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা। “সিন্ডিকেটের রোজনামচা” শিরোনামের এ পরিবেশনায় বর্তমান সময়ে দেশের নানা অসাম্য, শোষণ-বঞ্চনা ও নৈরাজ্যের চিত্র তুলে ধরেন উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা। এটি গ্রন্থনা করেছেন উদীচীর সহ-সভাপতি জামসেদ আনোয়ার তপন, সংগীত পরিচালনায় সুরাইয়া পারভীন এবং নাট্যাংশ পরিচালনা করেছেন বিজন রায়। এরপর বিভাগীয় পর্যায়ে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার ও সনদপত্র তুলে দেন আমন্ত্রিত অতিথি এবং উদীচীর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

এরপর একে একে অন্য আয়োজনগুলো অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার (৯ মার্চ) বিকাল ৪টায় উৎসবের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালা আয়োজিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে কার্যক্রম। এরপর উদীচী সংগীত বিভাগের সমবেত পরিবেশনা দিয়ে শুরু হবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। এরপর শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি এবং দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক মাহমুদ সেলিম। এরপর দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ের বিজয়ীদের হাতে ফুল, ক্রেস্ট এবং সনদপত্র তুলে দেবেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। এ পর্বটি সঞ্চালনা করবেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক এবং দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা প্রস্তুতি পরিষদের সদস্য সচিব, সঙ্গীতা ইমাম। পরে, সন্ধ্যায় জাতীয় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করবেন। আমন্ত্রিত দল হিসেবে সমবেতভাবে গণসংগীত পরিবেশন করবে বহ্নিশিখা/চারণ-এর শিল্পীরা। একক সংগীত পরিবেশন করবেন প্রলয় সাহা এবং তুষার দে। সব শেষে উদীচীর দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতার সমাপনী ঘোষণা দেবেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। এ পর্বটি সঞ্চালনা করবেন উদীচী কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কংকন নাগ।

Scroll to Top