আধুনিক পৃথিবীতে খুব কম স্থানই আছে যার রহস্য মানুষ জানে না। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত স্যাটেলাইট ব্যবস্থা পৃথিবীর গন্ডি পেরিয়ে গ্রহ থেকে গ্রহতে পৌঁছে দিয়েছে মানুষকে। অথচ, সেই আধুনিক বিশ্বের মানুষদের কাছেই এখনো রহস্যে ঢাকা রয়েছে সেন্টিনেল দ্বীপ।
২১ শতকের এই বিশ্বে এমন কোনো জায়গা থাকতে পারে যা অনাবিষ্কৃত বা মানুষের নাগালের বাইরে, কথাটা অসম্ভব শোনালেও আন্দামানের উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপটি আজও ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে পৃথিবীর মানুষের কাছে।
বঙ্গপোসাগরের বুকে অবস্থিত রহস্যময় দ্বীপটি উত্তর আন্দামান নিকোবরের অন্তর্ভুক্ত। নৃতাত্বিকদের মতে, প্রায় ৬০ হাজার বছর পূর্বে এটি সৃষ্টি হয়েছিল। যার বর্তমান আয়তন ৭২ বর্গকিলোমিটার।
কাগজে কলমে সেন্টিনেল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও দেশটির কোনো কর্তৃত্ব নেই এর ওপর। ভারত সরকার বহুবার চেষ্টা করেও দ্বীপটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারেনি। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, তারা দ্বীপটিতে প্রবেশ করতে পারেনি। এর একমাত্র কারণ হলো দ্বীপটিতে বসবাসরত অধিবাসীরা। দ্বীপটিতে কতোজন মানুষ বাস করে তার সঠিক কোনো হিসাবও পাওয়া যায়নি।
২০০১ সালে সরকারীভাবে দ্বীপটির ব্যাপারে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে সে চেষ্টা অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। অসম্পূর্ণ সেই পরিসংখ্যানে মাত্র ৩৯ জন বাসিন্দার উল্লেখ পাওয়া গেলেও ধারণা করা হচ্ছে দ্বীপটিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১-৫’শ এর মতো। সেন্টিনেল দ্বীপের বসবাসরত অধিবাসীদের সেন্টিনেল জনগোষ্ঠী বলা হয়। এরা সভ্যতার আলো হতে দূরে থাকা এক শিকারী জনগোষ্ঠী। যারা গাছের ডালপালার তৈরি ঘরে বাস করে। পরনের বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লতাপাতা। সেন্টিনেলের বাসিন্দারা ঠিক কোন ভাষায় কথা বলে তাও জানা যায়নি। ধারণা করা হয় এদের ভাষার সঙ্গে আন্দামানিক ভাষাগুলোর মিল রয়েছে।
দ্বীপের বাসিন্দারা প্রচণ্ড হিংস্র ও আদিম মানসিকতার। এদের নিষ্ঠুরতার অনেক কাহিনীও শোনা যায়। ২০০৬ সালে দুই জেলে ভুলক্রমে ওই দ্বীপে ঢুকে পড়ে। ফলাফল স্বরূপ দ্বীপের অধিবাসীরাদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তাদের। জেলেদের উদ্ধারে পাঠানো হেলিকপ্টার হতে তাদের লাশ দেখা গেলেও সম্ভব হয়নি তা উদ্ধার করা। দ্বীপের অধিবাসীরা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করেও তীর ও বর্শা ছোড়া শুরু করে! যে কারণে জেলেদের উদ্ধার না করেই শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারটি ফেরত আসতে বাধ্য হয়।
এই দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বহুদিন ধরে। ১৯৬৭ সালে প্রথম ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা শুরু করে। ভারতের ট্রাইবাল ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক টিএন পন্ডিতের নেতৃত্বে ওই সময় চেষ্টা শুরু করা হয়। যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা হিসেবে দ্বীপটির তীরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপহার যেমন; খাবার, পোশাক ইত্যাদি রেখে আসা হতো।
কিন্তু তাতেও শখ্যতা গড়তে পারেনি দ্বীপবাসীর সাথে। দ্বীপের কাছে কোনো নৌকা বা আকাশে কোনো হেলিকপ্টার দেখলেই তীর, পাথর ও বর্শা জাতীয় অস্ত্র ছুড়ে মারে তারা।
১৯৯০ সালের দিকে মধ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত এরকমই একটি জনগোষ্ঠী “জারওয়া”দের সঙ্গে এক সংঘর্ষে বহিরাগত কিছু মানুষ প্রাণ হারান। ওই ঘটনার পর ভারত সরকার সেন্টিনেল দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা বন্ধ করে দেয়। আশেপাশের অন্তত ৩ মাইল এলাকার মধ্যে বাইরের পৃথিবীর মানুষের প্রবেশের ব্যাপারেও কড়াকড়ি আরোপ করে ভারতীয় সরকার।
ওই ঘটনার প্রায় এক শতাব্দী আগের কথা। ১৮৮০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলেও এই দ্বীপটির বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেবার দ্বীপের ৬ জন বাসিন্দাকেও তুলে আনা হয়। এরমধ্যে চারজন ছিলো শিশু। প্রাপ্তবয়স্ক দু’জনকে দ্বীপ হতে আনার পরপরই মারা যায়। বাকি বাসিন্দাদের কিছুদিন রাখার পর কোনো তথ্য না পেয়ে তাদের ওই দ্বীপে রেখে আসা হয়।
জানা যায়, ২০০৪ সালের সুনামিতে দ্বীপটিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই বাসিন্দারা আবারও সুনামির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে। সুনামির কিছুদিন পর এক হেলিকপ্টার হতে দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
বর্তমানে দ্বীপটি ভারত সরকারের অধীনে থাকলেও, দ্বীপের অধিবাসীদের জীবনযাত্রায় বহির্জগতের প্রভাবমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দ্বীপটিতে যেতে বাধা না দেওয়া হলেও, ভারত সরকার বিশেষভাবে সতর্ক করে আসছে দ্বীপটিতে প্রবেশের ব্যাপারে। এক কথায় দ্বীপের বাসিন্দাদের কেউ মাড়াতে চান না। তাদের মতো করেই বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চান না স্বয়ং ভারত সরকার। তাই বর্তমানে এই রহস্যময় দ্বীপটির বাসিন্দারা রয়েছেন নিজেদের মতো করেই। দুনিয়ার মানুষ অন্ধকারে রয়ে গেল এই দ্বীপবাসীর জীবন বৈচিত্র নিয়ে।