ঢাকা, ২৬ জুন – বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তির বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বকেয়া পাওনা আছে বলে দাবি করেছে ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেড।
সম্প্রতি আদানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিল সারদানা বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে এক চিঠিতে এই বকেয়া অর্থ পাওয়ার তথ্য তুলে ধরেন।
বকেয়া অর্থ না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি তীব্র আর্থিক চাপে পড়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠিতে আদানি সরাসরি অনুরোধ করেছেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেন কৃষি ব্যাংকসহ নির্ধারিত ব্যাংকের মাধ্যমে ইউএস ডলার বরাদ্দ দেয়, যাতে পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর দেশের অভ্যন্তরে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার এবং সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ভারতের ঝাড়খণ্ডেরে গোধদা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে আদানি পাওয়ার লিমিটেড। এটি বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যুৎ আমদানি প্রকল্পের একটি অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচিত। আদানির ভাষ্য অনুযায়ী, তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখলেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বারবার অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, বিপিডিবি মাসে গড়ে ৯০-১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে থাকলেও, পূর্বের বকেয়া অর্থের পরিমাণ মে ২০২৫-এর শেষ নাগাদ ৯০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংক ও ঋণদাতাদের কাছে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে।
আদানির অভিযোগ, বিদেশি মুদ্রার ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ চুক্তিভিত্তিক সময়সূচি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না, যা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ক্রয়ের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
ঋণ করে উৎপাদন চালাচ্ছে আদানি
চিঠিতে আরও বলা হয়, বিপিডিবির এই অর্থ না দেওয়ার কারণে আদানির আর্থিক অবস্থাও সংকটময় হয়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তারা এখন উচ্চ সুদের ঋণের মাধ্যমে জ্বালানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করছে। বিদেশি ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীরা পুঁজি সরিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, যার ফলে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে আদানি বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের কাছ থেকে ‘বিশেষ হস্তক্ষেপ’ চেয়েছে। চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেন কৃষি ব্যাংকসহ নির্ধারিত ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের পাওনার বিপরীতে যথাযথ পরিমাণে ইউএস ডলার বরাদ্দ করে।
এছাড়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অন্যান্য ব্যাংকে ডলার বরাদ্দের প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই আদানির পাওনা মেটানো হোক।
এদিকে আদানি ৯০০ মিলিয়ন ডলার পাওনার দাবি করলেও বাংলাদেশ বলছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার। এই সমস্যার মধ্যেই নতুন করে শুরু হয়েছে অর্থ পরিশোধের জটিলতা। বিদ্যুৎ বিভাগ আদানির বকেয়া পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগের কাছে টাকা চাইলেও অর্থ বিভাগ তা দিতে অস্বীকার করেছে। অর্থ বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০১৭ সালের চুক্তির ছায়া এখন বাস্তব সংকট
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও আদানি পাওয়ারের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (PPA) স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, গোধদা থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে এবং বাংলাদেশ নির্দিষ্ট শর্ত ও সময়সূচি অনুযায়ী মূল্য পরিশোধ করবে। এই চুক্তি শুরু থেকেই বিতর্কের জন্ম দেয় বিশেষ করে মূল্য নির্ধারণ, ডলারে লেনদেন ও রপ্তানির নির্ভরতার কারণে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তিতে বাংলাদেশ এখন আর্থিকভাবে প্রতিনিয়ত চাপে পড়ছে। বিদ্যুৎ আমদানির ব্যয় মেটাতে সরকারের বাজেট সংকুচিত হচ্ছে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের পরিস্থিতি আগামীতে আরও বাড়বে যদি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বাড়ানো না যায়। এছাড়া, আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সক্ষমতা না বাড়িয়ে এককভাবে বিদ্যুৎ আমদানির ওপর নির্ভরতা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
সূত্র: বাংলানিউজ
আইএ/ ২৬ জুন ২০২৫