সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যমেই ঘুরে ফিরে বাজছে একটি গান, ‘ছি রে ননি’! এদিক সেদিক কান পাতলেই ভেসে আসছে ‘ছি রে ননি’! এটি নিয়ে হাজার হাজার কন্টেন্ট এরইমধ্যে তৈরী হয়েছে! তবে শুনলে অবাক হবেন, এই গানটি কিন্তু এই সময়ের নয়, এটি তৈরী হয়েছে কমপক্ষে ৩৩ বছর আগে!
এতো পুরনো গান কী করে এতোদিন পর ছড়িয়ে গেল, এটা একরকম বিস্ময়! প্রায় ৩৩ বছর পুরনো গানটি কন্টেন্ট ক্রিয়েটররাও কী দেখে লুফে নিলেন, তা অবশ্য গানের উপস্থাপনাতেই বিদ্যমান! মাসখানেক আগেও যে গানটি মাত্র লাখ খানেক ভিউ ছিলো, সে গানটির ভিউ ইউটিউবে ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে কোটির উপর!
সোশাল মিডিয়াতে বিভিন্ন কন্টেন্ট-এর বদৌলতে ইউটিউবে গানটির ভিউ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। গানটি নিয়ে তৈরী হয়েছে অনেকের আগ্রহ। জানতে চাইছেন, গানটির পেছনের গল্প!
মূলত গানটি ভারতের ওড়িশা রাজ্যের প্রধান ভাষা ওড়িয়ার গায়ক প্রয়াত সত্যনারায়ণ অধিকারীর গাওয়া। তিনিই একমাত্র ‘ছি রে ননি’র মাস্টারমাইন্ড! বলা হয়ে থাকে, ওড়িয়া ভাষায় এক অবিস্মরণীয় সংগীত প্রতিভা ছিলেন এই সত্যনারায়ণ।

ওড়িশার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন সত্যনারায়ণ। তার অসামান্য সংগীত প্রতিভা ও অবদান ওড়িয়া সংগীত জগতে বিশেষ ছাপ রেখে গেছে। তিনি শুধু একজন গায়কই ছিলেন না, বরং একাধারে সুরকার, গীতিকার এবং আইনজীবীও ছিলেন। তার বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ছি রে ননি’। যা সম্প্রতি আবার জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং বিভিন্ন প্রজন্মের শ্রোতাদের মন কেড়েছে।


ঐতিহ্যে গাঁথা এক অনন্য উত্তরাধিকার
সত্যনারায়ণ অধিকারী জন্মগ্রহণ করেন ওড়িশার সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ কোরাপুট অঞ্চলে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ওড়িশার বৈচিত্র্যময় আদিবাসী ঐতিহ্যের সংস্পর্শে ছিলেন, যা তার শিল্পীসত্ত্বাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি আজীবন আদিবাসী ও লোকসংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কাজ করেছেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও জয়পুর-এর স্বীকৃত শিল্পী হিসেবে তিনি ওড়িয়া সংগীতের গ্রাম্য সৌন্দর্যকে বৃহত্তর শ্রোতা সমাজের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
তবে অধিকারীর সংগীতজীবন শুধুমাত্র পরিবেশনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি গভীরভাবে ওড়িশার আদিবাসী সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য অনুধাবন করে আধুনিক সংগীতের সঙ্গে সেগুলোর এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন, যা সাধারণ মানুষকেও আকৃষ্ট করেছিল।
‘ছি রে ননি’: এক অবিস্মরণীয় গান
সত্য নারায়ণের অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘ছি রে ননি’ এক অনন্য সৃষ্টি। ৩২ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রকাশিত এই গানটি তখন থেকেই তার গভীর আবেগ ও হৃদয়স্পর্শী কথার জন্য শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল। ভালোবাসা, প্রতারণা ও বিরহের সূক্ষ্ম অনুভূতি তুলে ধরার কারণে গানটি যে কোনো মানুষের মনে নাড়া দিতে সক্ষম। এই গানটি প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে অ্যালবাম ‘বালি ফিল’-এ।
সম্প্রতি, ‘ছি রে নানি’ নতুনভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। গানটির পুনরুজ্জীবন সত্যনারায়ণ অধিকারীর সংগীতের চিরন্তন আবেদনকেই প্রমাণ করে বলে মনে করছেন ওড়িয়াভাষী সংগীত সংশ্লিষ্টরা। মিম, নাচের ভিডিও এবং কভার পারফরম্যান্সের মাধ্যমে এটি নতুন প্রজন্মের কাছেও পৌঁছে গেছে, যারা এখন তার শিল্পের জাদু নতুনভাবে আবিষ্কার করছে।
সংগীতের প্রতি অঙ্গীকার
সত্যনারায়ণ অধিকারী কেবল একজন সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক সৃজনশীল শক্তি। সুরকার ও গীতিকার হিসেবেও তিনি একাধিক হৃদয়স্পর্শী গান রচনা করেছিলেন, যা সুরের বৈচিত্র্য ও গভীর কথার জন্য বিখ্যাত। তার সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিভা এবং গল্প বলার ক্ষমতা তাকে ওড়িশার ঘরে ঘরে জনপ্রিয় করে তোলে।
সংগীত জগতের পাশাপাশি তিনি আইন পেশাতেও সফল ছিলেন। সংগীত ও আইন—এই দুটি ভিন্ন ক্ষেত্র দক্ষতার সঙ্গে সামলানোর ক্ষমতা তাকে আরও অনন্য করে তুলেছিল। তার সতীর্থ ও ভক্তরা তার এই বহুমুখী প্রতিভার প্রতি সবসময় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
গানের আড়ালে এক মহান শিল্পী
অধিকারী ছিলেন বিনয়ী এবং নিজের শিল্পের প্রতি গভীরভাবে নিবেদিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সংগীত হল এক মহান শক্তি, যা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তার রেকর্ডিংগুলোর মাধ্যমে তিনি প্রেম, ঐক্য ও সংস্কৃতির গৌরবময় বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
২০১২ সালের ২৫ জুন, দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর সত্যনারায়ণ অধিকারীর জীবনাবসান ঘটে। তার মৃত্যু ওড়িয়া সংগীত জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি বলে মনে করেন সেখানকার সংগীতসংশ্লিষ্টরা।
তারা মনে করেন, ‘ছি রে ননি’-এর সাম্প্রতিক পুনরুজ্জীবন সত্যনারায়ণের শিল্পকর্মের চিরকালীন গুরুত্বকেই তুলে ধরে। তার ভক্ত অনুরাগীরা মনে করছেন, আসল সুর ও আন্তরিকতার শক্তি কখনোই হারিয়ে যায় না। তথ্যসূত্র