কবি হেলাল হাফিজ শাহবাগে সুপার হোমে থাকতেন। সেখানে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যান, পিজিতে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন (৭ অক্টোবর ১৯৪৮- ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪)। ৭৬ বছর বয়স ছিল কবির। লিখেছিলেন বাংলাদেশে বেশি বিক্রি হওয়া কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। হেলাল হাফিজের ইন্তেকালের খবরে কবি সাদী কাউকাব লিখেছেন, ‘বাংলাদেশকে বাংলাদেশি কবিতা উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ’। বিষয়টি ঠিক তাই। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি কবিতার পালস ধরতে পেরেছিলেন। না চাইতেই তিনি এই ভূখণ্ডকে যা দিয়েছেন তা রাষ্ট্রের স্বীকার করা উচিত। সমকালীন সময়ে তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি বলা হয়। বাংলা ভাষায় একটি মাত্র বই লিখে আর কোনো কবি এতো জনপ্রিয় হয়নি। প্রিয় কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শিল্প সংস্কৃতি জগতের অনেকেই বেছে নিয়েছেন ফেসবুককে। তেমনি কিছু পোস্ট নিয়ে এই আয়োজন-
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মমর মন দারুণ খারাপ প্রিয় কবির প্রস্থানে। দিয়েছেন দুটি স্ট্যাটাস। লিখেছেন, ‘‘নিউট্রন বোমা বোঝ/ মানুষ বোঝা না / মানুষ হয়তো সব বুঝবে / মানুষকে বুঝবে না…’ কিংবা ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিলেন প্রিয় কবি হেলাল হাফিজ। অনন্তে এই যাত্রা শুভ হোক।’’
প্রখ্যাত অভিনেত্রী বন্যা মির্জা কবির উৎসর্গ কবিতাটি পোস্ট করেছেন, ‘আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো / আপনাকে, তোমাকে ও তোকে। / কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা? / কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন? / কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন? / কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো / চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত, / তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত। / কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে / খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে / কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।…’
গুণী অভিনেতা রওনক হাসান লিখেছেন, ‘প্রস্থান কবি হেলাল হাফিজ! অনন্ত যাত্রা আনন্দময় হোক।’
জনপ্রিয় নির্মাতা দীপঙ্কর দীপন লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়- তারই কবিতার লাইন। ফেরিওয়ালা কবিতার তিনি কষ্ট ফেরি করে বিক্রি করেছিলেন- কষ্ট নেবে কষ্ট / হরেক রকম কষ্ট আছে / কষ্ট নেবে কষ্ট! / লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট / পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট / আলোর মাঝে কালোর কষ্ট / ‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে / কষ্ট নেবে কষ্ট।’
জনপ্রিয় উপস্থাপিকা মৌসুমী মৌ কবির সঙ্গে একটি পুরনো ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুঃখী নই, দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয় যে, আমাকে দুঃখ দেবে।’
‘আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে কিছু থাকে, হোক না তা শ্যামল রঙ ছাই, মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না কিচ্ছু থাকে না, খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই।’ ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয় কবি হেলাল হাফিজ!
সিনিয়র সাংবাদিক গাজী নাসিরউদ্দিন আহমেদ খোকন লিখেছেন, ‘কবিতা খুব কম পড়েছি বলা যাবে না। কিন্তু কবিতার বই সেই অর্থে কিনি নাই। এরপরও ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কিনেছিলাম। চট্টগ্রামের স্টেশন রোডে অমর বইঘর নামে একটি পুরনো বইয়ের দোকান ছিল, সেখান থেকে। আমার কলেজের খাতায় নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতার লাইন লিখে রাখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম আমার এক বন্ধু হেলাল হাফিজের কবিতায় বিরাজিত বিরহের লাইন কোট করে। ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো এমন মলিন। সেই কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রয়াত বেবী মওদুদ। আপার ক্লাসমেইট ছিলেন কিংবা এক ক্লাস নিচে পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েকবারই কবির সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। যৌবনে তার মিছিলের ডাক উপেক্ষা করা আমাদের প্রজন্মের জন্য কঠিন ছিল। মার্চের গণহত্যার রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি আজ থেকে আর লৌকিক নন। মিছিলের কবি, ভালবাসার কবি হেলাল হাফিজ, আপনার প্রস্থান সত্যিই বেদনার।’
আরেক সাংবাদিক মৌসুমী আচার্য্য লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
জীবন নামক যুদ্ধ; বিকেলের রোদের মতো খেয়ালী মেজাজে পাড়ি দিয়ে চিরবিদায় নিলেন কবি হেলাল হাফিস। ‘এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে, এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে’- এমন অনবদ্য সব উচ্চারণ পিছনে ফেলে চলে গেলেন যাবতীয় অধিকার ও এখতিয়ারের বাইরে। বিদায় অনবদ্য প্রেমিক, অসামান্য কবি।
নির্মাতা খিজির হায়াত খান কবির অটোগ্রাফটি সংযুক্ত করে লিখেছেন, ‘ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয় কবি।’
সাংবাদিক মারজান ইমু লিখেছেন, ‘গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে? / আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি, / নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়? / এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে, / এক জীবন কতোটা আর কষ্ট দেবে!’ বিদায় হে প্রিয়, বিদায়…
মূকাভিনয় শিল্পী নিথর মাহবুব লিখেছেন, ‘প্রিয় কবি, দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ ইন্তেকাল করেছেন।’
মঞ্চ নির্দেশক ওয়াহিদুল ইসলাম এই কার্ডটি শেয়ার করেছন।’
তরুণ অভিনেতা ইভান সাইর লিখেছেন, ‘বিদায় কবি। আজ থেকে আরও জীবন্ত হেলাল হাফিজ।’
শিশু সাহিত্যিক পলাশ মাহবুব লিখেছেন, ‘কবি হেলাল হাফিজ শারীরিকভাবে চলে গেলেও কবিতায় তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।’
জনপ্রিয় নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী লিখেছেন, ‘‘একজন অভিমানী কবি। তিনি বাংলার কবি। হেলাল হাফিজ। পরপারে ভালো থাকবেন আপনি। শ্রদ্ধা আর প্রণাম। ‘কেউ জানে না কেনো তোমার এমন হলো কেনো হলো! / জানি তুমি ভালোই আছো / ভালো থেকো / পত্র দিয়ো।’ প্রার্থনা আপনার জন্যে। এভাবেই শূণ্য হচ্ছে আমাদের চারপাশ।’’
তরুণ সাংবাদিক নাজমুস সাকিব রহমান লিখেছেন, ‘‘হেলাল হাফিজের প্রথম বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ যখন আমার হাতে আসে তখন হাই স্কুলে পড়ি। ততদিনে বইটার বয়স দুই দশক পার হয়ে গেছে। প্রচ্ছদেও বদল এসেছে। এরপর কত কত দিন পার হলো। তার অনেক কবিতা এখনো মুখস্ত রয়ে গেছে। যদিও ‘কষ্ট নেবে কষ্ট’ শুনলেই আমার বিশ্রি রকম মেজাজ খারাপ হয়। অবশ্য ‘স্লোগান লেখক’ হিসেবে তার বদনাম আছে। মেয়েরা পছন্দ করে বলেও। সে থাকুক, কিন্তু তার দুটি কবিতা আমি ভীষণ পছন্দ করি। একটা হলো ‘কিছুই পারিনি দিতে, এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম’। এটা ছিল তার পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড। বাম রাজনীতির প্রতি তার আহ্বান। তিনি জানতেন মানুষের কথা কারা বলে।
আরেকটা কবিতা খুব ছোট্ট। তিনি বলছেন, ‘কে আছেন?/ দয়া করে আকাশকে একটু বলেন— সে সামান্য উপরে উঠুক/ আমি দাঁড়াতে পারছি না।’ সাহিত্য বিচারে বিদগ্ধদের কাছে এগুলো হয়তো কিছুই না। কিন্তু আমার মতো অনেক সামান্য মানুষ যারা প্রচণ্ড পরিশ্রম করেও দাঁড়াবার জায়গা পাচ্ছে না— তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল এই শব্দগুলো। এই ঢাকা শহরে আমি চাইলেই তার কাছে যেতে পারতাম। প্রেস ক্লাবে তিনি যেভাবে সবাইকে খাওয়াতেন হয়তো আমার ক্ষেত্রেও তাই হতো। কিন্তু কখনো ইচ্ছে করেনি। কী জিজ্ঞেস করব, সবই তো পড়া। ইন্টারভিউ নেব? ওটাও তো সিফাত নিয়ে রেখেছে। আমার জন্য বাকি ছিল শুধু ছবি তোলা। আমার কাছে তার ফোন নম্বর আছে কয়েক বছর হলো। এখন সবই অতীত। খোদা তার পরবর্তী জীবন শান্তিময় করুক। আমিন।’
এছাড়া নির্মাতা মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, প্রীতি দত্ত, ইরানি বিশ্বাস, সাংবাদিক লাবন্য লিপি, সঙ্গীতপরিচালক সুমন সাহাসহ অনেকে প্রিয় কবিকে নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।