সোনার স্বপ্নের স্বাদ কালো রঙে ভেসে যায় বাতাসে | চ্যানেল আই অনলাইন

সোনার স্বপ্নের স্বাদ কালো রঙে ভেসে যায় বাতাসে | চ্যানেল আই অনলাইন

গতকাল সোমবার ২১ জুলাই দুপুর ১ টা ২০ মিনিটে ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ-এর একটি ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান এফটি-৭ বিধস্ত হয়। বিমানটি দোতলা ভবনের সামনে ক্র্যাশ ল্যান্ড করে। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিকক্ষ। সর্বোপরি ভবনটিতে প্রাথমিকের ক্লাস চলে। ছুটির পর মাধ্যমিক পর্যায়ে কোচিং ক্লাস চলে।

দুর্ঘটনাটি ঘটে ছুটির দশ/বারো মিনিট আগে। ঠিক এই সময়টাতে ছাত্র-ছাত্রীর কতটা অস্থিরতা, কতটা প্রাণ চাঞ্চল্যতায় ক্লাসে সোরগোল শুরু করে তা জানেন উপস্থিত শিক্ষক। নিত্যদিনই যেন তাদের ‘কী করি আজ ভেবে না পাই’ এমন অবস্থা। শিক্ষক প্রতিদিনই ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। কেননা পিতা-মাতা তুল্য শিক্ষক ছাত্রকে কতটুকু শাসন, স্নেহ-ভালোবাসা প্রদান করেন তা তিনি নিজে ছাড়া অন্য কেউ তা বুঝতে পারে না। ছুটি, আহা রে ছুটি! মাইলস্টোন স্কুলের কোমলপ্রাণ শিশুরা জীবনের ছুটি নিয়ে যেন ফুল হয়ে ফুটে তারা হয়ে আকাশে উঠে গেছে।

গতকাল দুপুর ২টায় ফেইসবুক পোস্ট দেখে জানতে পারলাম মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা। এই সময় আমি বাসায় একা। একেবারে স্তব্ধ হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। দু’এক জনের যাদের ফোন রিসিভ না করলেই না হয় তাদের সাথে অল্প কথায় শেষ করলাম। শক্তিহীন হয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে যেতে পারলাম না। আজ আমাদের প্রতিষ্ঠান ( উত্তরা ইউনাইটেড স্কুল অ্যান্ড কলেজ) থেকে সব ম্যাডাম মিলে দিয়াবাড়ি মাইলস্টোন স্কুলে গিয়ে নিজ চোখে দেখে এলাম হৃদয়বিদারক ঘটনাস্থল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা জোগাতে শিল্পীরা গেয়েছেন ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।’ সত্যি, শিশুরা ফুলের মতোই সুন্দর আর পবিত্র হয়ে মায়ের কোলে জন্ম নেয়। ফুলের মতো সুন্দর এই শিশুগুলো ছিল উত্তরার শোভা। উত্তরার সর্বত্রই ছিল তাদের বিচরণ। শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র বলা চলে উত্তরা মডেল টাউনকে। স্কুল এবং কলেজ মিলিয়ে (২০০৫-২০২৫) আজ বিশ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িয়ে আছি। ‘উত্তরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ এ ইন্টারভিউ দিয়ে আমরা একঝাঁক শিক্ষক জয়েন করলাম। আমি-আমরা সবাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মাইলস্টোনকে হটিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। বাস্তবে তেমনটা হয়নি। ঢাকা স্কুল থেকে মাইলস্টোন স্কুলের ১১নং সেক্টরের ক্যাম্পাসে সমাপনী পরীক্ষায় কর্তব্যরত শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি। ক্যাম্পাসের ভেতর-বাহির খুব সুন্দর। এখানে মেয়েরা ছিলো বিধায় স্বস্তিও তুলনামূলকভাবে। ছয়টি পরীক্ষার শেষ দিন স্বল্প সময়ের মধ্যে মেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরলো এই যে তাঁদের সাথে হৃদ্যতা আজও স্মৃতিতে অম্লান। পৃথিবীর সকল শিক্ষকের কাছে সকল ছাত্রই সন্তানতুল্য, তা কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। আহারে প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী আহা!

নজিরবিহীন প্রমাণ দিয়ে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এর শিক্ষিকা মেহেরিন চৌধুরী। তিনিই হয়তো কোন ক্লাসে পড়িয়েছেন, ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।’ তিনি নিজের জীবনের কথা না ভেবে কোমলপ্রাণ ছাত্রছাত্রীর বাঁচাতে এগিয়ে যান, সাহস দেন, ভরসার হাত বাড়িয়ে দেন। এই বাংলায় তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকুক। যাই হোক, শিক্ষকের নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানোই শিক্ষকের কাজ।

মাইলস্টোন স্কুলের আকস্মিক দুর্ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবগত হওয়া সম্ভব হয়েছে সকলের পক্ষে। আর তাই উদ্ধার কাজে লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা উপস্থিত হন। দিয়াবাড়ি মাইলস্টোন স্কুল সংলগ্ন কোনো হাসপাতাল না থাকায় মেট্রোরেলের সহায়তায় এবং আ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের প্রেরণ করা হয়। হাসপাতালগুলোর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহিদ মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতি দ্রুত ব্লাড ডোনার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। আহত রোগীদের সুস্থ করে তোলার কাজে দেশের অনেক মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে বহির্বিশ্বে বসবাসকারী বাঙালির মনেও এমন হৃদয়বিদারক ঘটনায় মর্মাহত। যেন এই কচি কচি শিশুরা সকলেরই আত্মীয়। এমন পর্যায়ে পরিবারগুলোর মধ্যে বিশেষ করে মা-বাবা কীভাবে এই শোক সামলে নিবেন। যে মা কিংবা বাবা গেটে অপেক্ষা করছেন এ-ই তো ছুটি হলেই হাত ধরে প্রতিদিনের মতো বায়না মিটাতে মিটাতে কত কথা, কথার ফুলঝুড়ি। সাধারণত মা-ই সন্তানকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যান। মা কীভাবে মেনে নেবে এই কষ্ট! এ তো মনকে শান্ত করা কিছুই নেই।

আনিসুল হক এর ‘মা’ গল্পের (বাস্তব জীবনের কথা) মা সাফিয়া বেগম ছেলে আযাদকে হারিয়ে চৌদ্দ বছর বেঁচে ছিলেন ভাত না খেয়ে। আহা মা! কীভাবে তার সোনামনিকে স্কুলে পাঠিয়ে দেড়টায় ছুটি হবে অথচ এই জীবনে সেই মা আর কোনোদিন বুকের মানুকে ফিরে পাবেন না। মহান আল্লাহ পাক যেন শোকতপ্ত পরিবারকে ধৈর্যধারণ করার শক্তিটুকু দান করেন।

এখানে অনেক সম্ভবনাময় মেধাবী শিক্ষার্থীও ছিল। যারা হয়তো বুয়েট, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যায়ে অধ্যায়ন করে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অজর্ন করতে পারতো। কী না হতে পারতো এই ভবিষ্যৎ নাগরিকেরা! আজ কেবলই তাদের জন্য আহাজারি আর দীর্ঘশ্বাস। যে সকল আহত শিশু চিকিৎসাধীন তাদের যেন আল্লাহ তায়ালা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেন এবং হারিয়ে যাওয়া শিশুরাও যেন পরিবারকে ফিরে পায়।

বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে চেষ্টা করে সফল হতে পারেননি। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এর কোমলপ্রাণ শিশুরা আহত এবং নিহত হয়েছেন। এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরস্পরকে দোষারোপ না করে দেশবাসীর উচিত সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা এবং এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা আর না ঘটে সেই সতর্কতা অবলম্বন করা।

হিংসা, পরচর্চা, লোভ বর্জন করা প্রয়োজন। একটি কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যা ‘‘জুলাই রক্ত কেড়ে নেয়, সর্বনাশে মাস’’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। মানুষের জন্য আল্লাহর দান প্রতিটা দিনই শুভ। মঙ্গলবার ২২ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এই শোক যথাযথ মর্যাদাপূর্ণ হউক।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এর আকস্মিক দুর্ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কল্যাণ সাধন হউক।

লেখাটা শেষ করছি পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের কবিতা ‘পল্লীজননী’ কবিতার পঙক্তি দিয়ে-‘‘শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গনিছে ছেলের আয়ু/শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে/চলে বুনো পথে জোনাকি মেয়েরা কুয়াশা কাফন/ সে কথা ভাবিতে পরান শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে।’’

(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Scroll to Top