সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের করুণ প্রস্থান: জীবনের শেষ লেখায় অব্যক্ত বেদনা | চ্যানেল আই অনলাইন

সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের করুণ প্রস্থান: জীবনের শেষ লেখায় অব্যক্ত বেদনা | চ্যানেল আই অনলাইন

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার আর নেই। বৃহস্পতিবার সকালে অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। একদিন পর শুক্রবার বিকেলে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার বলাকির চর এলাকায় মেঘনা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। মৃত্যুর আগে তিনি একটি ‘খোলা চিঠি’ পাঠিয়ে যান স্থানীয় একটি গণমাধ্যমে, যেটিকে তিনি তার ‘জীবনের শেষ লেখা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

নিখোঁজের ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের ছেলে ঋত সরকার একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। পরিবার জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে আর ফেরেননি তিনি। শুক্রবার বিকেলে মেঘনা নদীতে অজ্ঞাতনামা এক মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে ছবি মিলিয়ে শনাক্ত করে বিভুরঞ্জনের পরিবার। পরে মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে মরদেহটি শনাক্ত করা হয়।

শেষ লেখায় ব্যক্তিগত হতাশা ও পেশাগত বঞ্চনার বর্ণনা

মৃত্যুর ঠিক আগে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে একটি লেখা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ পাঠান বিভুরঞ্জন সরকার। লেখাটির ফুটনোটে তিনি অনুরোধ করেন, ‘জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।’

লেখাটিতে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের জীবনের ব্যর্থতা, আর্থিক টানাপড়েন, পরিবারে অসুস্থতা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা এবং সাংবাদিক জীবনের নানা বঞ্চনার গল্প। তিনি লেখেন:

আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও এ-ডাল ও-ডাল করে কোনো শক্ত ডাল ধরতে পারিনি। আমার কোথাও না কোথাও বড় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি আর কাটিয়ে ওঠা হলো না। দুঃখই হোক আমার জীবনের শেষ সঙ্গী। আর পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।

চার বছর কাজ করেও বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতি না হওয়ায় লিখেছেন,

“আজকের পত্রিকা’য় কাজ করছি ৪ বছর হলো। এই সময়ে না হলো পদোন্নতি, না বাড়ল বেতন। অথচ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিদিন,”

তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে দীর্ঘ পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করলেও আর্থিকভাবে কখনোই স্বচ্ছল ছিলেন না। ‘আজকের পত্রিকা’য় চার বছর কাজ করেও পদোন্নতি বা বেতন বাড়েনি বলে লেখেন তিনি।

তিনিএ-ও লিখেছেন,

“বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও নাকি কতজন ভাগ্য বদলেছেন। অথচ আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত দুটি বইয়ের জন্য আমি দুই টাকাও রয়্যালিটি পাইনি। একেই বলে কপাল!

রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সরকারের প্রতি অভিমত

লেখায় তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের প্রতি হতাশাও প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনার আমলে অনেক সাংবাদিক সুযোগ-সুবিধা পেলেও তিনি নিজে দুইবার প্লটের আবেদন করেও ব্যর্থ হন। লেখেন:

শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা পরিচয়ে অনেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন… আমি দুইবার আবেদন করেও সফল হইনি।

তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে সংবাদপত্রে কাজ করা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠেছে। একটি রাজনৈতিক লেখার কারণে তার সহকর্মীদের ওপর চাপ আসে এবং একাধিক লেখা পত্রিকা থেকে প্রত্যাহার করতে হয়।

পরিবার ও সন্তানদের নিয়েও দুশ্চিন্তা

বিভুরঞ্জন সরকার তার ছেলের চাকরি না পাওয়া এবং মেয়ের পরীক্ষায় খারাপ ফল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। উল্লেখ করেন, পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ, তিনি নিজেও আর্থিক টানাপড়েনে ভুগছেন।

বুয়েট থেকে পাস করা ছেলের চাকরি হচ্ছে না। মেডিকেল পাস মেয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট। এসব দেখে কীভাবে স্বস্তিতে থাকি?

জীবনের শেষপ্রান্তে উপেক্ষিত একজন সাংবাদিক

দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক মাতৃভূমি’, ‘সাপ্তাহিক চলতিপত্র’, ‘সাপ্তাহিক একতা’, এবং ‘সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ’-এ কাজ করেছেন বিভুরঞ্জন সরকার। আশির দশকে ‘তারিখ ইব্রাহিম’ ছদ্মনামে ‘সাপ্তাহিক যায় যায় দিন’-এ তাঁর রাজনৈতিক লেখাগুলো ছিল পাঠকপ্রিয়।

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের এই পরিণতি শুধু একটি ব্যক্তির জীবনের করুণ উপাখ্যান নয়, বরং সমাজে উপেক্ষিত থাকা অসংখ্য প্রবীণ পেশাজীবীর প্রতিনিধির গল্পও বটে। একদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, অন্যদিকে পেশাগত অস্বীকৃতি—এই দুইয়ের চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। আর সে কারণেই, জীবনের শেষ লেখায় রেখে গেছেন হতাশা, ক্ষোভ ও নিরব কান্নার অনুরণন।

Scroll to Top