সকল মহিমা তোমার

সকল মহিমা তোমার

অনুচিত প্রহরের মালা
যত ফুল দিয়ে গাঁথা
আর রঙের কচি কচি যত ব্যথা
বানের জলের মতন
রিপুর এত আগ্রাসন মনে—
মনের গোপন!
সকরুণ বীণা বাজে
আপনার সুরে—
আর্তনাদ বাতাসে মেলায়
কষ্টের পরিখায় চেয়ে দেখে
এত অনুতাপ—
জগতের সমস্ত পাপ
শূন্য, দ্বিধাহীন শূন্য হয়ে
উড়ে যায়—
হাশরের ময়দানে—
শেষ বিচারের দিনে
ইয়া নফসি, ইয়া নফসি
মন তড়পায়!
নাই হতে এসে
নাই হয়ে গেছে প্রাণ—
প্রাণের অ-ঘ্রাণে
তোমার চোখের কোণে
কিছুটা বিষাদ রয়েছে জমা—
এই স্তুতি রয়ে যাবে শুধু
তোমার ধু ধু অন্তরে
সকাতরে।

আদি অগ্নিপিণ্ড ভরে
জলের স্বভাবে অস্থির
স্থির নাই কোনো কিছু আর
তোমার চোখের তারার বয়ান
অফুরান গীত—
অতীত কিছু নাই!
কালের কল্লোল
মিছামিছি অযথাই!
পরান ফুরিয়ে গেছে
পরানের সমস্ত গান—নতুন আহ্বান
জেগেছে মাতৃআলয়ে—
নিশিকালে কুপিবাতি জ্বলে
তোমারে হারায়ে—
তবু গুণগান
সকল মহিমা তোমার—
তুমি মহীয়ান।

অরূপ সেরূপ থেকে এসে
সকল রূপের দেশে
নাই-রূপ হয়ে লুকায়েছে মন
মনের গুপ্তধন!
কে সে গুপ্ত থেকে
করে আলোড়ন
ঘোরে-বেঘোরে রিপুর নাচন—
কারে সাকারে ভাসায়
কোন মহাদূর থেকে কাঁদায়-হাসায়।

গুহার পরতে পরতে
বিভীষিকা হয়ে আসে অন্ধকার—
আঁধার আঁধার ছড়িয়ে পড়ে
কার সাথে সখ্য করে
চলেছে সুদূর পারে—
অনবদ্য উপমায়—
রুহ উড়ে যায় সাত আসমান
কালার বাঁশরী ভেঙে খানখান
তসবির দানার বেদনার সমান
অন্তরের তারারে নাচায়।
তারাদের ভাই আমি
গায়ে মেখে অশেষ আলোক
আদমের গরিমায় দূরে সরে যায়
আগুনের সমস্ত পুলক!
 
আগুন ভালোবেসে
পোড়াবেদনায় হেসে
শূন্য থেকে আরও শূন্যতায়
অদ্ভুত চাঁদোয়ায়—
মানুষ চিরদিন নয়,
সহসা মরে যায়!

শব্দ থেকে অ-শব্দের গরিমায়
ধ্যানে, নির্জ্ঞানে—
ভাষার মুকুট থেকে নির্ভাষায়
অসংখ্য সংকেতে ধায়—
রূপরসগন্ধবর্ণস্পর্শহীন
দূরের অ-মায়ায়।
হৃদয়কমল ভেসে যায় ডরে—অজানা শঙ্কায়
তুমি কোন জলে নেমে কাঁদো বুকের ব্যথায়!
শুধায়নি এসে কেউ কেন নাচে বায়ুর প্রলাপ
পাখি উড়ে গেলে—শূন্যে—পড়ে থাকে অনুতাপ!
খোদাই করেছে অন্তর সুমিষ্ট বিষ ঢেলে
কার নামে—
চিকিমিকি প্রসূনের ডানা মেলে
সে আসে বৈকুণ্ঠধামে।

অন্তর বাহিয়া ঝরে যে বেদনা
মিহি মিহি দানা তার
উপেক্ষায় পড়ে থাকে নিঃস্ব হয়ে—
নিঃসার—
সকল মহিমা তোমার।

এতটা অবহেলার
ভার পুঁতেছে নিজেই বিষের বিষ
সকাতর করুণার—
তোমার পাষাণ সমান হিয়ায়
বাজে বিচিত্রিত ধ্বনি
চঞ্চলতার—
সকল মহিমা তোমার।
তবু মরে যায় জ্ঞানের লহর—
সুমহান খ্যাতি—
বিনাশের দিকে ধায় গরিমা,
আপনার—
সকল মহিমা তোমার।
বায়ুর মহল থেকে
বহু বহু মানবের যান এসে
ভিড়েছে যে তীরে,
তার পাড় ভেঙে পড়ে ক্রমে
বিভ্রমে, বৃথা জগতের রূপ-ধ্যান
বিফলে গেলে জেগে ওঠে
নতুন চরাচর,
জগতে কে আপন-পর
ভেদ নাই, অন্তরের শানে—
সাত আসমানে নূরের ঝিলিক
নেমে আসে মানুষের জমিনে!
জমিন ছেড়ে আমাদের আদিপিতা
ছেড়ে গেছেন কত সায়র দূর
বাঈজির নৃত্যের নূপুর আজও পড়ে আছে
অলক্ষ্যে বেজে ওঠে—
রিনঝিন,
সমস্ত বেদনাবোধের অন্তর
সকাতর বেদনায় চিনচিন।
বেদনার সাথে থেকে গোপনে গোপনে
বাতাসে ছড়িয়ে দেয় মায়া কানে কানে—
লাভা গলে গলে সে-ও হয় মোমের যাতনা
বলে, যাও পাখি বলো তারে তুমি ভুলো না!
আর অনন্ত দুঃখের
পরিখায়—
অতিকায় মলিন অধ্যায়
লীন হয়ে আসে—

তারপর নুহের প্লাবনের পর
জেগে ওঠে নতুন প্রাণ
আগুয়ান—
মহাঘড়ির কাঁটায় বসে দোলে
কালের সায়র—
মানবের সকল বিশ্বাস
আপন দিলে আপনার—
সকল মহিমা তোমার।
আপনায় আপন মাঝে
ব্যথায় বাজে গভীর অসুখ
সুরত কাহার রূপে আসে
ভুবন মাঝে কাঁপায়ে মুখ!
এই রতি রত্নমণিহার দুর্গতিনাশ!
ঊর্ধ্বগতি রোধ করে রিপুর বিনাশ।
সর্বলোকব্যাপী—
দ্যুলোক-ভূলোক আলোক ছেড়ে
বাহির হয়েছে নয়া দ্যুতি
উল্লাসে ভেদ করে!

জগতের ভেদ যত উড়াল বাতাসে হাসে
অলৌকিক মহাপ্রাণ লৌকিক দেহে ভাসে।
দেহরে সাজিয়ে নাও মাঝি ছাড়া বাও
চন্দ্র-সূর্য চেয়ে আছে জলে ডুব দাও।

জলে জলে ভাসে
অনন্ত মানুষরূপ জগৎসভার।
সকল মহিমা তোমার।
সকল মহিমা লয়ে
স্রোতেলা নদীরে শুধায়ে
খোয়াজখিজির জেগে ওঠেন ঊর্মিলার তালে
বিচূর্ণ পানির ফেনায় কলকল আশেকান—
উছলে ওঠে জল, উড়ে যায় সাত আসমান!
সুনসান-স্তব্ধ হলে ছলচ্ছল ধ্বনি, খিজির ঘুমান!

এ কেমন তামাশা তোমার
ভাসা ভাসা কাঁঠালপাতায় পিপীলিকা
সকরুণ স্রোতে ভেসে যায়
ধুকপুক বুকে বয়ে বয়ে কোন পারে ভিড়ে
অশেষের কোন দরিয়ায়!

সে এক অচেনা অরূপ জগৎ
জগতের অনুরূপ রূপ নাই
মায়ার জগৎ থেকে পিপীলিকা
নিঃস্বতায়, একেলা করলাই!
তুমি কে—কোন মহাজন—রঙ্গিলা সাঁই
আদমে আদম সৃজিয়া নিরাকার হইলাই।
আকারে বিকারে এত শান, এত হকিকত
জাহের-বাতেনে আদমের কত না গালত!

কত রূপ, কত রং
তোমারই সে প্রতিরূপ—
নিরাকার সাকার হয়
বিভা অপরূপ!

জগৎপ্রবাহে ভেসে চলে কত নায়রীর নাও
পিপীলিকা ভাসে সেই রূপজলে—
উজালা দুনিয়ার যত ভাব, যত মায়া
অরূপে নিরাকারে বয়ে যায় মহাকালে—
সকল মহিমারাজি—
আপনার রূপ—
কাল নিরবধি
মানবের তরে প্রেম—
সতত অনুভবার
আপনায় দিলে, পরম আপনার—

সকল মহিমা তোমার।

Scroll to Top