বলিউডের আর্ট ঘরানার ছবির প্রবক্তা বললে ভুল হয় না শ্যাম বেনেগালকে। শুধু আর্ট ঘরানা নয়, বানিজ্যিক ধাচের ছবি করেও তিনি সফল হয়েছিলেন। জীবনঘনিষ্ট গল্প, গভীর মানবিকবোধ ও সুক্ষ আবেগ দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতেন তার সিনেমায়। তার হাত ধরে উঠে এসেছিলেন শাবানা আজমী, নাসিরউদ্দিন শাহ, স্মিতা পাতিলের মতো জাদরেল অভিনয়শিল্পী। শ্যাম বেনেগাল প্রসিদ্ধ তার আইকনিক ক্ল্যাসিক সিনেমা ‘অঙ্কুর’, ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’, ‘মাণ্ডি’, ‘ভূমিকা’, ‘মাম্মো’, ‘সর্দারি বেগম’, ‘জুবাইদা’র জন্য।
গত ২৩ ডিসেম্বর ৯০ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়। শ্যাম ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। তার প্রয়াণে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে একটি যুগের অবসান হলো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাকে বলা হয় ভারতীয় সিনেমার অন্যতম স্তম্ভ। গুণী এই নির্মাতার মৃত্যুতে বলিউড, টলিউড ও ঢালিউডে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
শ্যাম বেনেগালের মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়ে টুইট করেছেন বলিউড মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আরেকজন অদম্য সাহসী নির্মাতাকে হারালাম।’
কিংবদন্তি ভারতীয় অভিনেত্রী শাবানা আজমী লিখেছেন, ‘তিনি আমার কাছে গুরুর মতো। চিন্তায় অনেক আধুনিক ছিলেন।’ শাবানা আজমী এর আগে এক সাক্ষাৎকারে শ্যাম বেনেগালকে নিয়ে বলেন, ‘শুধু অভিনয় নয়, আমি কীভাবে জীবনকে দেখি সেখানেও তার প্রভাব ছিল।’ ৭৪ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী আরও বলেন, ‘আমি তার সাথেই প্রথম বিদেশে যাই ‘অঙ্কুর’ সিনেমা নিয়ে এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করি। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে আবিষ্কার করেছিলেন এই সিনেমার মাধ্যমে।’
বিজ্ঞাপন
নির্মাতার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী কাজল। টুইট করেছেন, ‘তার কাজ দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন। ভারতীয় সিনেমায় তার অবদান অনস্বীকার্য।’
বলিউড সুপারস্টার অক্ষয় কুমার টুইট করেছেন, ‘তিনি ছিলেন অন্যতম অসাধারণ নির্মাতা। সাধারণ একটা চেহারা বা ঘটনাকে তিনি দারুণভাবে কাব্যিক করে তুলতেন।’
বলিউডের আরও অনেক বিখ্যাত তারকার মতো শোকাহত টলিউড অভিনেতারাও শোকাহত । শ্যাম বেনেগালের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘লেজেন্ডের বিদায়ে শ্রদ্ধা। চিত্রনাট্যের গুরু যিনি বাস্তব চিত্র এবং গভীরতা দিয়ে ভারতীয় সিনেমাকে নিয়ে গেছেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে।’
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত শোক জানিয়েছেন এই নির্মাতার মৃত্যুতে। তিনি ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন, ‘তার মতোই উদার তার প্রতিটি ছবি। যেখানে মানুষের গল্প বলা হয়েছে। যেখানে স্বাধীন যাপনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে।’ ২০২৩-এ মুক্তি পায় শ্যাম বেনেগালের শেষ ছবি ‘মুজিব: দ্য মেকিং অব আ নেশন’। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘রঞ্জন ঘোষের ‘আহারে’ সিনেমায় আমার বিপরীতে আরিফিন শুভকে দেখেছিলেন শ্যামজি। সেখান থেকেই তার ‘মুজিব’ ছবির জন্য শুভকে বেছে নেন।’’
সেই আরিফিন শুভ প্রিয় নির্মাতার মৃত্যুতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক জানিয়ে লিখেছেন, ‘ওপারে ভালো থাকবেন স্যার।’ সাথে পোস্ট করেছেন সিনেমার শুটিংয়ের সময়ের একটি ছবি।
এই সিনেমার আরেক অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমকে শোক জানিয়ে বলেছেন, ‘ভারত তথা বিশ্বের সিনেমার মানচিত্রে শ্যাম বেনেগালের মতো প্রতিভা চট করে পাওয়া যায় না। বিরল। দীর্ঘ সময় এমন প্রতিভাবান মানুষ আসে না। সুতরাং, শ্যামের চলে যাওয়া ছবির জগতের জন্য আক্ষরিক অর্থেই বড় ক্ষতি। ওই বয়সেও ছবি তৈরির সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর থাকত শ্যামের।’
ছবির প্রতি শ্যামের এই যে একাগ্রতা, ভালোবাসা তা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারেননি চঞ্চল। বলেন, ‘বয়সের দোহাই দিয়ে কোনোদিন ছবির সেটে অনুপস্থিত থাকেননি শ্যাম। মনিটরে শুটিংয়ের প্রতিটি শট দেখতেন এবং সবকিছু নিখুঁত হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি থাকতো এই নির্দেশকের।’ সব মিলিয়ে, বয়স যে শিল্প তৈরির ক্ষেত্রে কোনও বাধা হতে পারে না, তা শ্যামকে দেখেই বুঝেছিলেন তিনি।
‘মুজিব: দ্য মেকিং অব আ নেশন’ সিনেমার আরেক অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদিন দীঘি শোক জানিয়ে লিখেছেন, ‘শান্তিতে থাকবেন স্যার। আপনার সাথে কাজ করা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।’
১৮টি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বেনেগাল তার কর্মের মাধ্যমে সাধারণত প্রচলিত সিনেমার ধারার বাইরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিষয়কে গভীর দৃষ্টিতে তুলে ধরতেন। ১৯৭৬ সালে পদ্মশ্রী এবং ১৯৯১ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত শ্যাম বেনেগালের অবদান ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।