১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যে বাধা হ্রাস এবং টেকসই উন্নয়নের প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী শুল্কনীতি এবং প্রতিষ্ঠান-বিরোধী অবস্থানের ফলে।
বছরের শুরুতে বানিজ্য সংস্থার ৩০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ডব্লিউটিও’র মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইওয়ালা বলেন, বিশ্ব বাণিজ্যের এই অনিশ্চয়তা অনেক সদস্যকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে কেন তারা বিশ্ব অর্থনীতিতে এবং বাণিজ্যে সংলাপ এবং সহযোগিতার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ডব্লিউটিওকে মূল্য দিচ্ছে।
ট্রাম্পের বাণিজ্য উত্তেজনা
২০২৫ এর শুরুতে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ১৯৩০ এর দশকের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সুরক্ষাবাদী অবস্থান নির্দেশ করেছে। যদিও তিনি পারস্পরিক শুল্ক স্থগিত করেছিলেন, তবে তা ১ আগস্ট পুনরায় কার্যকর হবে। এই সিদ্ধান্ত মার্কিন ভোক্তা ও ব্যবসার ব্যয় বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহ ব্যাহত করেছে এবং প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের কাছ থেকে প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছে।
নির্দলীয় নীতি গবেষণা কেন্দ্র ইয়েলের দ্য বাজেট ল্যাবের মতে, মার্কিন শুল্ক হার শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর ফলে ডব্লিটিও’র বিশ্ব বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বিরোধ নিষ্পত্তির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
ট্রাম্পের অভিযোগ
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে, ট্রাম্প শুল্ককে শক্তিশালী নীতিগত হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি শুল্ককে অভিধানের সবচেয়ে সুন্দর শব্দ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং মার্কিন সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপের পক্ষে জোর দেন। তিনি ডব্লিউটিও এর সমালোচনা করে বলেন, তারা স্বদেশীর চাকরি রক্ষার পরিবর্তে কম মুল্যকে অগ্রাধিকার দেয়।
ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে অর্থনৈতিকভাবে হেরে গেছে, বিশেষত ২০০১ সালে চীনের বাণিজ্য সংস্থায় প্রবেশের পর থেকে। ১৯৭৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি মোট ২০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যেখানে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
ট্রাম্প ডব্লিউটিওকে চীনকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে মার্কিন শ্রমিকদের অবমূল্যায়ন করার জন্য দোষারোপ করেন। তিনি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীনের “বিশেষ এবং বৈষম্যমূলক আচরণ” এর প্রতিও আপত্তি জানিয়েছিলেন।
ট্রাম্প ২০২০ সালে ডব্লিউটিও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন কারণ এটি চীনকে পার পেয়ে যেতে দিয়েছে। যদিও ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন সমস্যা ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়,তবে ধনী দেশ গুলীর কাছে প্রথম দৃশ্যমান হয় ১৯৯৯ সালে। তবে নতুন করে ট্রাম্পের কঠোর সমালোচনা এবং সুরক্ষাবাদী নীতিমালা বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
সিয়াটলে যুদ্ধ ট্রাম্পের অনুপ্রেরণা
১৯৯৯ সালের শেষের দিকে, ওয়াশিংটনের সিয়াটলে ৫০,০০০ মানুষ জড়ো হয়ে ডব্লিউটিও-এর প্রতি তাদের অভিযোগ প্রকাশ করে। বিক্ষোভকারীরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে বানিজ্য সংস্থার শ্রম, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সুরক্ষাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তাদের দীর্ঘদিন ধরে যে মানগুলির জন্য তারা লড়াই করে আসছে তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিক্ষোভকারীরা মনে করতেন, মাইক্রোসফট, নাইকি, ফোর্ডের মতো বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তাদের বিপর্যস্ত করেছে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত শ্রমিকদের মুদ্রাস্ফীতি-সমন্বিত আয় কমেছে, তবে বিনিয়োগকারীদের লাভ উল্লেখযোগ্য বেড়েছে। এই অবস্থা তাদের অসন্তুষ্ট করেছিল।
সিয়াটল ছাড়াও নিউ ইয়র্কসহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের বিক্ষোভে “কর্পোরেট শাসনের অবসান ঘটাও” এবং “আমরা ন্যায্য মজুরি চাই” লেখা প্ল্যাকার্ড ছিল।
অবশেষে, চার দিনের অচলাবস্থার পর বিক্ষোভকারীরা ন্যায্যতা পেয়ে বাড়ি ফিরে যায়। যা ২০১৬ সালে ট্রাম্পের মতো সুরক্ষাবাদী নেতাদের জনপ্রিয়তার পথ প্রশস্ত করে।
উন্নয়নশীল দেশগুলির মতবিরোধ
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী স্থল নিয়ম নির্ধারণ করে, চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে, নীতিমালা প্রয়োগ করে এবং দেশগুলি যখন মনে করে বানিজ্যের নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে তখন বিরোধ নিষ্পত্তি করে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে এর নীতিমালায় হতাশা প্রকাশ করেছে।
১৯৯০-এর দশকে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ নামে পরিচিত মুক্তবাজার নীতির প্রচারে ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জয়তী ঘোষের মতে, ডব্লিউটিও-তে বাণিজ্য চুক্তিগুলি সর্বদা উন্নত দেশের পক্ষে করা হয়। ট্রিপস (TRIPS) এর একটি অন্যতম উদাহরণ।
১৯৯৫ সালে প্রণীত ট্রিপস চুক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার কঠোর করার মাধ্যমে ধনী দেশগুলোর ওষুধ কোম্পানিগুলিকে সুবিধা দেয়, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জীবন রক্ষাকারী ওষুধের প্রবেশ কঠিন করে। উদাহরণসরূপ, ১৯৯০ এর দশকের শেষের দক্ষিন আফ্রিকায় এইচাইভি সংকট চলাকালীন সময়ে যেখানে ভ্যাকসিন বিশ্বের কিছু শক্তিশালী ফার্মা কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ফলস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকা জেনেরিক ওষুধ কিনতে অক্ষম ছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল।
কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের পর আবারও একই রকম একটি ঘটনা সামনে আসে যেখানে দেখা যায়, কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যবহৃত মেধাস্বত্বের খুব বেশি অংশ ফার্মা কোম্পানিগুলি তৈরি করেনি, তারা কেবল পেটেন্ট কিনেছে এবং সরবরাহ সীমিত করেছে এবং সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক গবেষণা নির্দেশ করে, বাণিজ্য বাধার সঙ্গে উন্নয়নের কোনও সুস্পষ্ট বিরোধ নেই, বরং অধিকাংশ ধনী দেশ সুরক্ষাবাদী নীতির মধ্য দিয়েই উন্নতি করেছে।
ফলস্বরূপ, উন্নয়নশীল দেশ মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদী শিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের প্রচেষ্টা সীমিত করার জন্য ডব্লিউটিও’র দ্বারা হতাশ হয়েছে। ধনী দেশগুলির বার্তা প্রায় ৩০ বছর ধরে স্পষ্ট: আমি যেমন বলি তেমন করো, আমি যেমন করি তেমন নয়। ট্রাম্পের অধীনে সেই বার্তা আরও গুরুত্ব পেয়েছে।
বাণিজ্য সংস্থার দোদুল্যমান অবস্থা
আন্তর্জাতিক বানিজ্য সংস্থা বর্তমানে একটি অস্তিত্বসংকটের মুখোমুখি। কারণ এটি দীর্ঘদিন ধরেই উত্তর-দক্ষিণ মতবিরোধ সমাধানে ব্যর্থ এবং এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী সদস্য নিয়ম লঙ্ঘন ও বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত করছে।
আফ্রিকার প্রাক্তন বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী রব ডেভিস বলেন, ডব্লিউটিও-এর ১৬৬টি সদস্য দেশের সম্মতিভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া একসময় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ধনী দেশগুলির জন্য উপযোগী ছিল। কিন্তু এখন চীন বিশ্বের প্রভাবশালী উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সাথে সাথে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে ধনী দেশগুলির দখল শিথিল হয়ে পড়ে।
ডেভিস আরও বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডব্লিউটিওর নিয়ম না মানার শুরু তখন থেকেই, যখন ট্রাম্প ২০১৯ সালের আগস্টে টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ে থেকে সরঞ্জাম কেনা থেকে ফেডারেল সংস্থাগুলিকে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
ট্রাম্প প্রশাসন আপিল সংস্থা অচল করে দেয়, যেখানে বানিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি হতো। যার ফলে বানিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে, বাইডেনও বাণিজ্য দ্বন্দ্ব সমাধানের কোনও কার্যকর উপায় প্রদান করেনি। ফলস্বরূপ, দেশগুলো এখন প্রায় শাস্তিমুক্তভাবে ডব্লিউটিও এর নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারছে।
এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য যুদ্ধ, মূল্যবৃদ্ধি এবং বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তার ঝুঁকি তৈরি করছে।
তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা করলেও, বাস্তবে গভীর আস্থার সংকট এবং মার্কিন নেতৃত্বের কারণে এই প্রতিষ্ঠানটির টিকে থাকা অনিশ্চিত করে তুলছে।