ড. মোঃ জাহিদুল ইসলাম: শিশু মন অতি কোমল। এই কোমল মনে শিক্ষার বীজ বপণ করতে হয় অত্যন্ত যত্নে। যাতে করে শিক্ষা বোঝা না হয়ে ওঠে শিশুর জীবনে। সুবিমল প্রাকৃতিক আবহে, আনন্দের মধ্য দিয়ে তার শিক্ষা প্রক্রিয়া প্রবাহিত হবে। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে অভিভাবকদের।
এ প্রক্রিয়ায় নানা প্রতিকূলতা আসবে, যেমন: সকল শিশুর মেধার ধরন একরকম নয়, ফলে সকলে একইভাবে শিখবে না। এ বাস্তবতায়, আনন্দের সাথে শিক্ষা প্রদান বিষয়টি সঠিক পরিকল্পনা, গবেষণা ও প্রয়োগের সাথে সম্পর্কিত।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে শিশুকে মুখস্থ বিদ্যা থেকে মুক্ত রেখে, স্কুলে আনন্দের অনুষঙ্গ স্থাপনের মাধ্যমে শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বিষয়টি সহজসাধ্য। সেখানে শিক্ষক-অভিভাবক-ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি সচল যোগাযোগ বিদ্যমান। শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত কম হওয়াতে শিক্ষক সহজে শিশুর প্রতি মনোযোগ নিবিষ্ট করতে পারে।
শিক্ষার্থী ভেদে শিখন শিক্ষায় নিতে পারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তাছাড়া অন্যান্য সুবিধাদি, যা শিশু শিক্ষার জন্য উপযোগী- সে উপাদান গুলো সেখানে যথাযথভাবে বিদ্যমান। ফলশ্রুতীতে উন্নত দেশগুলোতে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান তুলনামূলকভাবে সহজসাধ্য।
আমাদের দেশে শিশু শিক্ষায় আনন্দের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। এর দায় শিক্ষক, অভিভাবক, ব্যবস্থাপনা, নীতিমালা, প্রয়োজনীয় উপকরণ, শিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সকল কিছুর উপরই বর্তায়।
আজকের এ আলোচনায় আমরা এ বিষয়ে অভিভাবকের দায় বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবো। প্রত্যেকটি অভিভাবক শিশুর প্রথম শিক্ষক। এ বিষয়ে মায়ের প্রভাব অত্যন্ত বেশি বলে মনে করা হয়। শিশুর স্কুল গমনের পূর্বে নিজগৃহে, প্রধানত মায়ের কাছ থেকেই প্রথম শিখন প্রক্রিয়া শুরু হয়। একজন অভিভাবক এ সময় শিশুমনে শিক্ষাকে কিভাবে প্রোথিত করবে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একজন অভিভাবক যদি শিশুর মনস্তত্ব, শিক্ষাবিজ্ঞান সম্পর্কে চিন্তা না করে, শিশুর শিক্ষা গ্রহণে আনন্দের পরিবেশ না তৈরি করতে পারে, যদি শুরু থেকেই শিশুকে শেখার অশুভ প্রতিযোগিতার মধ্যে নিক্ষেপ করে, তাহলে গোড়াতেই শিক্ষা শিশুর কোমল মনে আনন্দ হিসেবে গৃহীত হবে না। একটু বড় হলে সে যখন বিদ্যালয়ে যুক্ত হলো, তখন অভিভাবকদের মনে অন্য শিশুদের তুলনায় শেখার ক্ষেত্রে তার শিশুটি কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে সে সম্পর্কিত জটিল হিসাব শুরু হয়।
এ হিসাব সে একা বহন করে না বরং শিশুর আনন্দে শেখার প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, সকল শিশুর শেখার প্রক্রিয়া ও পর্যায় সমান হয় না। অভিভাবক যখন তাকে শিখতে, শেখার প্রতিযোগিতায় অসমভাবে চাপ প্রয়োগ করে, তখন শিক্ষা গ্রহণ তার জন্য ভীতিকর হয়ে উঠতে পারে।
এ কথা সত্য যে, শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বহুমুখী সীমাবদ্ধতা আছে। তবে শিশুশিক্ষার আতুরঘর অর্থাৎ তার নিজ গৃহ বা অভিভাবকের কাছে শিশু শিক্ষা কি আনন্দের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে? এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। বড় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা আগামীদিনের অভিভাবক, এক্ষেত্রে এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিজ্ঞান ও শিশুমনস্তত্ব সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা প্রয়োজন। যাতে তারা পরে শিশু শিক্ষা এবং আনন্দ নিয়ে শিখা সম্পর্কে পূর্ব ধারনা লাভ করে।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকাও অগ্রগন্য। শিক্ষকরা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শিশু শিক্ষায় আনন্দের বিষয়টি অভিভাবকদের সামনে তুলে ধরতে পারেন। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অভিভাবক-শিক্ষক যোগাযোগ রক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, এসডিজি লক্ষ্য অর্জন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে একীভূত হতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল- আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগৌষ্ঠী তৈরি। যার শুরু হবে শিশু শিক্ষার মাধ্যমে। এখানে রাষ্ট্র কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তবে অভিভাবকরাও তাদের দায় এড়াতে পারেন না।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ‘দ্যা অ্যাটলান্টিক’ পত্রিকায় শিশু শিক্ষায় আনন্দ বিষয়ক এক নিবন্ধ ‘ হাউ টু শো কিডস দ্যা জয় অব রিডিং’ -এ আলোচনা করা হয়েছে কিভাবে শিশুদের আনন্দের সাথে শেখানো যায়। সেখানে বলা হচ্ছে, গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষা শিশুদের কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে। এ নিবন্ধে শিশুদের আনন্দে শেখানোর কৌশল হিসেবে বাস্তবতাকে বা প্রাণবন্ত, প্রাসঙ্গিক বিষয়কে শিশু শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছে।
যেমন: যখন শিক্ষার্থীদের ইতালি দেশ সম্পর্কে শেখানো হচ্ছে তখন কিছু স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রের কোন ইতালিয়ান হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে তারা ইতালিয়ান খাবার ‘স্পেগেটি’ খায়। পরে শিশু যখন ইতালি বিষয়ে মনে করতে যাবে, সহজেই এই ‘স্পেগেটি’ তার ইতালি সম্পকৃত স্মৃতিকে প্রসারিত করবে।
একইভাবে যখন তাকে এন্টার্কর্টিকা মহাদেশ সম্বন্ধে জানানো হবে, তখন তাকে পেঙ্গুইন নিয়ে কোন পাঠ দেয়া হবে। ফলে সহজেই আনন্দের মাধ্যমে সে শিখতে ও মনে রাখতে পারবে বলে মনে করা হয়। আমরা সীমাবদ্ধতার কারনে শিশুদের এ সুবিধা দিতে না পারলেও, আমাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে আনন্দের উপাদান নির্ধারন করে শিশুশিক্ষাকে আনন্দদায়ক করতে পারি।
যেমন, একজন মা তার শিশুকে ফল সম্বন্ধে শেখানোর আগে স্থানীয় সহজলভ্য ফল এবং ফলের গাছ দেখিয়ে শিশুকে এ সম্বন্ধে উৎসুক করে তুলতে পারে। একজন বাবা পানি সম্বন্ধে শিশুকে জানাতে শিশুর সাথে আনন্দ করে বৃষ্টি উপভোগ করতে পারে। এ প্রক্রিয়া শিশুকে পাঠ্য বইয়ের চাপ থেকে বা মুখস্থ করার তাগিদ থেকে মুক্ত থেকেও সহজে ও আনন্দে শিক্ষা অর্জন করতে সাহায্য করতে পারে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে আমরা কি এতটুকু প্রচেষ্টা করবো না?
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)