শিবনারায়ণ রায়ের রবীন্দ্রমূল্যায়ন

শিবনারায়ণ রায়ের রবীন্দ্রমূল্যায়ন

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরেকটি বক্তব্য আছে শিবনারায়ণ রায়ের আর সেটিই মূলত তাঁর প্রধান বক্তব্য এবং আফসোসের বিষয়, তা হলো ‘তিনি শেকসপীয়র, গোয়েটে ও ডস্টয়েভস্কির উত্তরসাধক নন’ এবং ‘তিনি মূলত শান্তির, প্রেমের, প্রত্যয়ের কবি।’ এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ নিজে তা-ই হতে চেয়েছিলেন কি না সেদিকে আগ্রহী না হয়ে তিনি তাঁর সাহিত্যসমগ্রে তাঁর বিপরীত চেতনার প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গের খোঁজ করেছেন শিবনারায়ণ রায়, খুঁজে পেয়ে তার আলোচনা করেছেন। চিত্রকলায় তার বিস্তর খোঁজ পেয়েছেন, সেখানে অবদমনের অপ্রস্তুত প্রকাশও লক্ষ করেছেন। পরে ছবিগুলোতে যা প্রকাশিত হলো তা কেন আগে সাহিত্যে সবিস্তার এল না, তার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকেই দায়ী করেন, কারণ বাধা বা ভাবমূর্তি যা–ই বলি, তিনি নিজেই তা তৈরি করেছিলেন, যেটি পরে আর ভাঙতে পারলেন না। কৃষকের জীবনের শরিক হতে না পারার বাস্তবতা থেকে একসময় তিনি যে লিখেছিলেন, ‘আমার কবিতা, জানি আমি,/গেলেও বিচিত্র পথে হয়নি সে সর্বত্রগ্রামী’, তা, শিবনারায়ণ রায়ের মতে, ‘তাঁর সুরের প্রধান অপূর্ণতা নয়। যাঁদের সঙ্গে তাঁর অন্তরের পরিচয় আছে বলে তিনি মনে করেছিলেন, তাঁদের কথাও যে তিনি বহু ক্ষেত্রে সত্য করে বলতে পারলেন না, এটিই তাঁর সাহিত্যের সব চাইতে বড় ত্রুটি।’ এসব বলে শিবনারায়ণ মূলত এই কথাটাই বলত চান, রবীন্দ্রনাথের যে প্রতিভা ও ক্ষমতা ছিল, তিনি চাইলে সেই ত্রুটি অতিক্রম করতে পারতেন, যেভাবে প্রেমের মাধ্যমে গোয়েটে ‘ভাবের পাঁচিল, নীতির পাঁচিল, ভাষার পাঁচিল’ অতিক্রম করেছিলেন।

আবার প্রেমের মাধ্যমে পাঁচিল টপকানোর কথা যখন উঠল, তখন শিবনারায়ণের আলোচনায় না আসা গোয়েটের প্রেমিকাদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আলোচনার কথা তো মনে পড়বেই। পাঁচিল টপকানোর প্রসঙ্গ তিনি তুলেছেন এ কথা বলার জন্য যে, মানুষ হয়েও শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বলতে পারলেন না মানুষের কোনো কিছুই তাঁর অনাত্মীয় নয়। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরও বললেন, ‘মানবতন্ত্র এবং মানুষের মাঝখানে ভাববাদী শুচিতা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।’ বিরাট রবীন্দ্র–রচনাবলী আর তাঁর শেষজীবনের নানা দৃষ্টান্ত সামনে নিয়েও এই মূল্যায়ন সেই সময়কার পাঠকদের বিচলিত করবারই কথা, তার পঁয়ষট্টি বছর পরে একালের পাঠকের কী প্রতিক্রিয়া হবে জানি না, তবে এ কথাটি নিশ্চয়ই মনে হবে যে, এর মধ্য দিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অনুসারী শিবনারায়ণ রায় নিজেও আরেক রকম শুচিতায় আক্রান্ত হলেন। আগ্রহী পাঠক নব মানবতাবাদের ২২টি সূত্রের কোনো কোনো চিন্তার পরিচয়ও খুঁজে পেতে পারেন তাঁর এ সব মন্তব্যে। আসলে শিবনারায়ণ রায়ের প্রকৃতিই এমন যে, তিনি যখন তাঁর প্রথম বই প্রেক্ষিত রচনা করেন সেই সময়কার লেখায় মার্ক্সবাদী চিন্তার প্রভাব ছিল, পরে মানবতন্ত্রী হয়ে উঠলে তাঁর লেখায় তারও ব্যাপক পরিচয় পাওয়া গেল। তিনি যে সুনির্দিষ্ট ধারণার আলোকে বিচার করতে পছন্দ করতেন, তার সত্যতা পাওয়া যাবে গোলাম মুরশিদের ‘শিবনারায়ণ’ শিরোনামক লেখায়। শিবনারায়ণ রায়ের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার সময় সন্দর্ভের প্রথম অধ্যায় লিখে তাঁর কাছে জমা দেন গোলাম মুরশিদ, কিছুদিন পরে শিবনারায়ণ তাঁকে জানালেন, লেখায় প্রচুর তথ্য আছে কিন্তু তাঁর ‘সুনির্দিষ্ট ধারণাগত কাঠামোটা’ কী, তা তিনি বুঝতে পারছেন না, অর্থাৎ ‘ইট–পাথর দিয়ে’ তিনি কী গড়তে চাচ্ছেন, তা তাঁর কাছে ‘প্রত্যক্ষ’ নয়। 

কিন্তু কথা হলো, সৃষ্টিশীল লেখকের পাঠবস্তু মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে সব সময় এ রকম পূর্বনির্দিষ্ট ধারণাকাঠামো থাকাটা জরুরি কি না। সাহিতের ইতিহাস তো বলে, গুরুত্বপূর্ণ পাঠবস্তু সব সময় তছনছ করে দেয় সব পূর্বধার্য ধারণাকে। এ দেশে অসংখ্য জাতিগোষ্ঠী আর অভিযাত্রীদের আগমনের পরে গড়ে ওঠা বিচিত্রমুখ ভারত-সংস্কৃতির প্রেরণা নিয়ে, নানা গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে সৃজন-মননে আমৃত্যু মগ্ন ছিলেন যে বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ, তাঁকে চিহ্নিত করার জন্য একজন মূল্যায়নকারী যদি কোনো নির্দিষ্ট চিন্তাকাঠামোর প্রতি অনুগত থাকেন, তাহলে সেই মূল্যায়ন খণ্ডিত হতে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শিবনারায়ণ যে মূল্যায়ন করেছেন, তার বহু মন্তব্যই এর দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

Scroll to Top