ভোরবেলা, গ্রামের মাটির আঙিনায় শিউলির গন্ধে ভরে উঠেছে বাতাস। সাদা পাড় সাদা শাড়ি পরে ঠাকুরমা মন্দিরমুখী হচ্ছেন, হাতে পূজার থালা। উঠোনে খেলা করছে ছোট্ট পুতুল, গাছ থেকে ঝরে পড়া শিউলি কুড়িয়ে হাসিতে গড়িয়ে যাচ্ছে। দূরে কাশবনে ভোরের হাওয়া দুলছে, পাখির কূজন মিশে যাচ্ছে ঢাকের শব্দে। শরৎ এসে পড়েছে— এ যেন কেবল ঋতুর পরিবর্তন নয়, বরং মানুষের মনে উৎসবের ডাক।
শরতের প্রথম আলো _
বাংলার ঋতুচক্রে শরৎ আসে এক ভিন্ন আবেগ নিয়ে। ভাদ্র–আশ্বিন মাস মানেই বর্ষার ভিজে ভিজে দিন শেষ হয়ে এক নতুন রঙে সেজে ওঠা প্রকৃতি। আকাশ যেন ধুয়ে-মুছে যায়, ভেসে আসে সাদা তুলার মতো মেঘের দল। নীল আকাশে ভেসে থাকা মেঘপুঞ্জ আর মাঠের ধারে ধারে ঝলমল করা কাশফুল— এই হলো শরতের আসল চিত্রকল্প।
প্রকৃতির স্নিগ্ধ সাজ _
বর্ষার ভারী বৃষ্টির পর যখন নদীর জল শান্ত হয়, চারপাশে জমে থাকা পানি সরে যেতে শুরু করে, তখনই ফুটে ওঠে শরতের নীরব সৌন্দর্য। কাশবনে বাতাস দুলে ওঠে, গ্রামের কাঁচা রাস্তায় ঝরে থাকা শিউলি ফুল বিছিয়ে দেয় সাদা গালিচা। ভোরের কুয়াশায় যেন গোপন কোনো কবিতা লিখে দেয় প্রকৃতি।
শরতের আবেগ _
শরৎ মানেই মধুর আলো-হাওয়ার ঋতু। স্নিগ্ধ সকালের নরম রোদ মানুষকে টেনে নেয় মাঠে, ঘাসে বসে শিশির ভেজার আনন্দ দেয়। এই সময়টায় গ্রামীণ জীবনে কৃষক ব্যস্ত হয়ে ওঠেন শস্যের মাঠে, নতুন ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতি চলে। আর শহরে— পার্ক, বাগান কিংবা ছাদের টবে ফোটে নানা রঙের ফুল।
উৎসবের ঋতু _
শরৎ শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের ঋতু নয়, এটি আনন্দ-উৎসবের ঋতুও। দুর্গাপূজা থেকে শুরু করে নবান্নের প্রস্তুতি— সবই শরতের আবহে মেতে ওঠে বাংলার মানুষ। পূজার প্রতিমা গড়ার সময় কাশফুল, শিউলির সৌরভ যেন উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে।
দুর্গোৎসবের আমেজ _
বাংলার শরৎ মানেই দুর্গোৎসব। গ্রামীণ মাটির প্রতিমা থেকে শুরু করে শহরের আলোকোজ্জ্বল পূজামণ্ডপ— সবখানেই দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। ঢাকের বাদ্য, কাশফুলের মায়া আর শিউলির গন্ধ মিলে যেন এক মহাসংস্কৃতির জন্ম দেয়। শুধু ধর্মীয় আচার নয়, দুর্গোৎসব আজ বাঙালির সামগ্রিক সংস্কৃতির অংশ— যেখানে সবাই মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করে।
সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শরতের ছোঁয়া _
বাংলা সাহিত্যেও শরতের আবেদন অমলিন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেমন শরতের নীল আকাশ ভেসে ওঠে, তেমনি জীবনানন্দের কবিতায় কাশবনের মায়া। শরৎকে ঘিরে অসংখ্য গান, পালাগান, নাটক রচিত হয়েছে। এই সময়কে ঘিরেই জন্ম নিয়েছে লোকসংস্কৃতির নানান ধারাও।
শরৎ কি শুধু ঋতু?
শরৎ তাই ঋতু নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পারিবারিক বন্ধন আর মিলনমেলার প্রতীক। নীল আকাশে ভাসমান সাদা মেঘ যেমন মনকে শান্ত করে, তেমনি শরতের উৎসব মানুষকে কাছে টেনে আনে, মনে করিয়ে দেয়— আমরা সবাই এই সংস্কৃতিরই অংশ।
নগরে শরৎ _
আজকের শহুরে জীবনে শরৎ হয়তো আগের মতো কাশবন আর শিউলির ছড়ানো রূপে আসে না, তবে সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে তার আবহ ছড়িয়ে পড়ে। দুর্গোৎসবের মণ্ডপ সাজানো, নবান্ন উৎসবের আয়োজন কিংবা শরৎকে ঘিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— সব মিলিয়ে শহরও উৎসবের আবেগে ভরে ওঠে।
আজকের ব্যস্ত শহুরে জীবনে হয়তো আমরা প্রকৃতির সেই স্নিগ্ধ শরৎকে খুব একটা খুঁজে পাই না। তবু নীল আকাশে যখন মেঘের ভেলা ভেসে যায়, কিংবা হঠাৎ কোনো কাশবনের সাদা ফুল চোখে পড়ে, মনে হয়— শরৎ এখনো আমাদের চারপাশে আছে, শুধু আমরা একটু খেয়াল করলেই তাকে ছুঁতে পারি।
ছবি: সংগৃহীত