লাগামহীন ওষুধের দাম, কিনতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ

লাগামহীন ওষুধের দাম, কিনতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ

জুমবাংলা ডেস্ক : দেশে ওষুধের দাম প্রায়ই বেড়ে যায়। গত কয়েক মাসেও বেড়েছে ওষুধভেদে প্রায় ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ। স্বল্প আয়ের মানুষ বাড়তি মূল্যে ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকের নিঃস্ব হওয়ার দশা।

লাগামহীন ওষুধের দাম, কিনতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষলাগামহীন ওষুধের দাম, কিনতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষওষুধের দামের এই লাগামহীনতার জন্য উৎপাদক ও সবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনৈতিক বিপণন চর্চা বা প্রোমোশনাল মার্কেটিং কার্যক্রমকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রোমোশনাল মার্কেটিংয়ের নামে ডাক্তারদের উপহার বা উৎকোচ দেয় কোম্পানিগুলো, যা কেটে নেওয়া হয় ক্রেতারই পকেট থেকে।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের মতে, রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান ওষুধ। রোগ নিরাময়ের মাধ্যম হিসেবে ওষুধের কোনো বিকল্প নেই। গুরুত্ব বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ওষুধকে স্বাস্থ্য খাতের ছয়টি অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের অন্যতম একটি হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে ওষুধের প্রাপ্যতা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের অন্যতম নিয়ামক।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এ সংক্রান্ত গবেষণা বলছে, দেশের মানুষের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ শুধু ওষুধের জন্য ব্যয় হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে মোট ১০০ টাকা খরচ করলে তার মধ্যে ৬৫ টাকা খরচ হয় ওষুধ কিনতে। এ থেকেই বোঝা যায়, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ওষুধের ওপর কতটা নির্ভরশীল।

দেশে গ্যাস্ট্রিক তথা অ্যাসিডিটির সমস্যা নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। এছাড়া দেশে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি পাঁচজনে একজন ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।

রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বিভিন্ন ধরনের গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। এরপরের বিক্রির তালিকায় রয়েছে যথাক্রমে প্রেসার এবং ডায়াবেটিসের ওষুধ। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় সারজেল, প্যানটোনিক্স এবং ম্যাক্সপ্রো। এছাড়া প্যারাসিটামল গ্রুপের নাপাও রয়েছে সর্বোচ্চ বিক্রিত ওষুধের তালিকায়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, কয়েক মাসে দেশে ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ। স্বল্প আয়ের মানুষ বাড়তি মূল্যে ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। ওষুধের দাম বৃদ্ধির ফলে জনসাধারণের মনে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অসহনীয় পর্যায়ে দাম বাড়ছে বলেও অনেকেই মনে করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের দাম বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসকদের মধ্যে চলা প্রোমোশনাল কার্যক্রমের নামে অনৈতিক বিপণন চর্চা। প্রোমোশনাল মার্কেটিংয়ের নামে ডাক্তারদের দেওয়া উৎকোচ বা উপহার কোনো কোম্পানিই নিজেদের পকেট থেকে দেয় না। ওষুধের দাম বাড়িয়ে সেই টাকা ক্রেতাদের কাছ থেকেই আদায় করা হয়। ওষুধের অনৈতিক বিপণন চর্চা বন্ধ করা গেলে বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে ওষুধের দাম অনেকটাই কমানো সম্ভব এবং কোম্পানির মার্কেটিং খরচ ১০ শতাংশে নামিয়া আনা সম্ভব।

ওষুধের উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় মূল্যের বিশাল পার্থক্য
ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের সাধারণ তত্ত্ব হচ্ছে, কস্ট অব গুডস অর্থাৎ উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হবে। মার্কেটিং, প্রোমোশন এবং অন্যান্য খরচ আরও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কোম্পানির মুনাফা।

ইসোমিপ্রাজল গ্রুপের সারজেল নামে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করে হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি। সারজেল ২০ মি.গ্রা. প্রতি পিস ৭ টাকা এবং সারজেল ৪০ মি.গ্রা. প্রতি পিস ১১ টাকায় বাজারে পাওয়া যায়।

ইসোমিপ্রাজল গ্রুপের আরেকটি ওষুধ ম্যাক্সপ্রো উৎপাদন ও বিপণন করে রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি। ম্যাক্সপ্রো ২০ মি.গ্রা. প্রতি পিস ৭ টাকা এবং ম্যাক্সপ্রো ৪০ মি.গ্রা. প্রতি পিস ১০ টাকা করে বাজারে পাওয়া যায়।

ওষুধ কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি ২০ মি. গ্রা. ইসোমিপ্রাজল গ্রুপের ক্যাপসুল এবং ট্যাবলেট কাঁচামালসহ উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ৭০ পয়সা। এর সঙ্গে এক্সিপিয়েন্ট (সহযোগী উপাদান), প্যাকেজিং, লেভেলিংসহ সর্বোচ্চ খরচ হয় দুই টাকা। প্রতি ৪০ মি. গ্রা. ইসোমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধ কাঁচামাল, সহযোগী উপাদান, প্যাকেজিং, লেভেলিংসহ সব মিলে মোট প্রায় দুই টাকা ৭০ পয়সা খরচ হয়। অর্থাৎ উৎপাদন খরচের কয়েকগুণ বেশি দামে ইসোমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধটি বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত লোসারটান পটাশিয়াম ১০০ মি.গ্রা. প্রতি ট্যাবলেটে উৎপাদনে খরচ হয় দশমিক শূন্য দশমিক ছয় পয়সা। সহযোগী কেমিক্যাল, প্যাকেজিং সব মিলে প্রতি ট্যাবলেটে ১ দশমিক ২৫ টাকার মতো খরচ হয়। এটা কোম্পানিভেদে বিক্রি করা হয় ১০ থেকে ১২ টাকায়। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মার্কেটিং ও প্রোমোশনাল খরচ।

ডায়াবেটিস রোগে ব্যবহৃত মেটফরমিন ৫০০ মি.গ্রা. এবং ৮৫০ মি.গ্রা. আকারে বাজারে পাওয়া যায়। মেটফরমিন ৮৫০ মি.গ্রা. প্রতিটির উৎপাদন খরচ হয় ৫৫ পয়সা, এর সঙ্গে এক্সিপিয়েন্ট (সহযোগী উপাদান) যোগ করলে মোট খরচ হয় ৭০ থেকে ৮০ পয়সা। প্যাকেজিংসহ এই ওষুধে প্রায় এক টাকা খরচ হয়। এটি প্রতি পিস বিক্রি হয় ছয় টাকায়।

প্রতিটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট উৎপাদনে গড়ে ৩০ থেকে ৫০ পয়সা খরচ হয়। এটি বিক্রি করা হচ্ছে ১ দশমিক ২০ টাকায়, মার্কেটিং খরচ বাদে যা থাকে সেটাই লাভ।

ওষুধ উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো ওষুধের গায়ে যদি মূল্য ১০০ টাকা থাকে, সেখান থেকে সরকার ভ্যাট পায় ১৫ শতাংশ, ফার্মেসির লাভ ১৫ শতাংশ। বাকি ৭০ টাকার মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কাঁচামালসহ উৎপাদন খরচ। আর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মার্কেটিং ও প্রোমোশনাল খরচ, বাকিটা কোম্পানির মুনাফা।

ওষুধ শিল্প নিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশে ওষুধের বিপণন বাবদ টার্নওভারের ২৯ শতাংশের বেশি খরচ করছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু এই বিপণন প্রক্রিয়াটি খুবই অস্বচ্ছ। ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রধানত ডাক্তারদের উপঢৌকন হিসেবে এই ২৯ শতাংশের বেশির ভাগ ব্যয় করে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক বিপণন চর্চা প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য বেসিক কেমিক্যাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম জামালউদ্দিন বলেন, ওষুধের দাম বাড়ার একটা বড় কারণ; ডাক্তারদের স্পিড মানি, খাম ও উপহার সামগ্রী দেওয়ার মাধ্যমে প্রায় কোম্পানির ৩০ শতাংশ ব্যয় হয়ে যায়। ডাক্তারদের যদি এসব না দিতে হতো তাহলে ওষুধের দাম বর্তমান বাজার মূল্যের থেকে ৩০ শতাংশ কম থাকতো।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাব্বির হায়দার বলেন, প্রোমোশনালের নামে চিকিৎসকদের বিভিন্ন উপহার, টাকা-পয়সা দেওয়াসহ অনৈতিক সব ব্যয় ওষুধের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই মূল্য ভোক্তাকেই পরিশোধ করতে হয়। কোম্পানি অযৌক্তিক এসব ব্যয় কমালে ওষুধের মূল্য বেশ কমে আসবে।

ওষুধের অনৈতিক বিপণন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, এটাকে আমরা বলি অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং। ওষুধের দাম যদি সরকারের প্রাইসিং ফর্মুলার ভিত্তিতে হয়, তাহলে কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত মূল্য নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। অতিরিক্ত মূল্য যখন নিতে পারবে না তখন ওষুধ কোম্পানির সারপ্লাস থেকেই অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিংয়ের খরচ বহন করতে হবে। তখন তারা এই অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং থেকে সরে আসবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ডাক্তারদের যেমন নৈতিকতা মেনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া উচিত ঠিক তেমনি ওষুধ কোম্পানিগুলোরও নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা করা উচিত। যদি ওষুধ কোম্পানিগুলো নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা করে এবং ডাক্তারদের কোনোরকম অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা না দেয় কিংবা ডাক্তাররা না নেয়, তাহলে ওষুধের দাম অবশ্যই কমে আসতে পারে।

চুয়াডাঙ্গায় যুবকের পায়ুপথ থেকে ৭২৮.৯৬ গ্রাম স্বর্ণের বার উদ্ধার

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ওষুধ কোম্পানির শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রোমোশনালের জন্য অর্থ ব্যয় না করলে আমাদের ওষুধ চলবেই না। ডাক্তাররা আরও বেশি চায়। ডাক্তাররা যদি কোনো সুবিধা না নেয়, তাহলে ওষুধের দাম হয়তো কমবে। আমাদের কোম্পানি ডাক্তারদের কোনো অনৈতিক সুবিধা দেয় না, বড় বড় কোম্পানি যারা এই ধরনের সুবিধা দেয়, তাদের এই বিষয়ে প্রশ্ন করাই ভালো।

Scroll to Top