রথযাত্রা ও আত্ম অহংকারের বিসর্জন | চ্যানেল আই অনলাইন

রথযাত্রা ও আত্ম অহংকারের বিসর্জন | চ্যানেল আই অনলাইন

অমিত নাথ: রথযাত্রা সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এতে রথের ওপর দেবতাদের মূর্তি স্থাপন করে রথ চালানো হয়। বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার উল্লেখ আছে, যেমন: ভবিষ্যপুরাণে সূর্যদেবের রথযাত্রা, দেবীপুরাণে মহাদেবীর রথযাত্রা, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও ভবিষ্যোত্তরপুরাণে বিষ্ণুর রথাযাত্রা বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার সময়কালও বিভিন্ন। কোথাও বৈশাখ মাসে, কোথাও আষাঢ় মাসে, আবার কোথাও কার্তিক মাসে রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

এই অনুষ্ঠান হয় আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে, আর একাদশী তিথিতে হয় প্রত্যাবর্তন বা ফিরতি রথ। অর্থাৎ রথটি প্রথম দিন যেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আটদিন পরে আবার সেখানেই এনে রাখা হয়। একেই বলে উল্টা রথ। রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া ভারতীয় রাজ্য ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে।

সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। রথযাত্রার দিন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরসহ দুই বাংলার সকল জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি সর্বসমক্ষে বের করা হয়। তারপর তিনটি সুসজ্জিত রথে (কোনও কোনও জায়গায় একটি সুসজ্জিত সুবৃহৎ রথে) বসিয়ে দেবতাদের পূজার পরে রথ টানা হয়। শাস্ত্রে আছে ‘রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।’

রথের ওপরে খর্বাকৃতি বামন জগন্নাথকে দর্শন করলে তার পুনর্জন্ম হয় না। তাই রথরজ্জু ধরে রথটানা মহাপুণ্য কর্ম বলে সনাতন ধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জগন্নাথের সাথে রথযাত্রা আর রথযাত্রার সাথে ওড়িশার নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ‘রথ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অক্ষ, যুদ্ধযান অথবা চাকাযুক্ত ঘোড়ায় টানা হালকা যাত্রীবাহী গাড়ি। বিশ্বকবি যে রথযাত্রার কথা কবিতায় লিখেছেন, সে রথযাত্রার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সে ইতিহাসে আছে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর আচার–প্রথার বর্ণনা। ছোট বেলায় ভাব সম্প্রসারণ এই লেখাটা অনেকে পড়েছি। কবিতার লাইন ছিল ‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম/ ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম/ পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসেন অন্তর্যামী।’

রথ যাত্রা মানেই বলরাম বা বলভদ্র, শ্রী কৃষ্ণ বা জগন্নাথ এবং সুভদ্রাদেবী এই তিনজনের সমাবেশ। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগম হয়। এখানে তিন দেবতাকে গুণ্ডিচা মন্দিরে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। পুরীতে বছরে এই এক দিনই অহিন্দু ও বিদেশিদের মন্দির চত্বরে এসে দেবদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। পুরীতে যে রথগুলো নির্মিত হয় তাদের উচ্চতা ৪৫ ফুট। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেলে এই রথযাত্রা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

বর্তমান সময়ে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষের মৃত্যু দেখছি। অনেক পরিবারের আর্থিক কষ্ট দেখছি। তারপরও কি আমরা আমাদের বিবেক জাগ্রত করতে পেরেছি। নিজের আত্মশক্তিকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করতে কি পেরেছি? নিজের শক্তিমত্তার জাহির করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় নৈতিকতা হারিয়ে ফেলি। আমরা প্রায় সবাই এক একটি পরিবারে বাস করছি। পরিবারে সহায় সম্পদ নিয়ে থাকার পাশাপাশি অনেকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার প্রত্যাশায় নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে থাকি। বিভিন্ন সময় আমরা শক্তি নিয়ে অহংকার করি। শক্তির প্রতিযোগিতা দেখাতে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে কখনো কখনো বিসর্জন দিয়ে থাকি। এই শক্তিকে আমরা বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করতে পারি। চলুন আমাদের সমস্ত অপশক্তি এবং আত্ম অহংকার শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের কাছে উৎসর্গ করি।

লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক

(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Scroll to Top