মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প: ‘কী লাগবে বড় ভাই’

মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প: ‘কী লাগবে বড় ভাই’

নগরীর মাদকের রাজধানী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। যেখানে সূর্য ওঠার আগেই অবস্থান নেন মাদক কারবারিরা। চলে গভীর রাত পর্যন্ত এ ব্যবসা। এই মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনায়ই দিনরাত মুখরিত হয়ে থাকে এই এলাকা। আধা কিলোমিটারের এই এলাকায় পদে পদে দেখা মেলে মাদক কারবারিদের সঙ্গে। আপন মনে সড়কে হেঁটে চললেও চারিদিক থেকে একই বাক্যে ভেসে আসে ‘কী লাগবে বড় ভাই’! ‘বড় ভাইদের’ আপ্যায়নে যেন একটুও কমতি নেই তাদের!

গেল শনিবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ মাদক ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শিশুসহ আহত হন অন্তত ৩ জন। একইদিন রাতে আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হয় সংঘর্ষ। তবে এত বড় ঘটনার পরেও রাত পেরিয়ে সকাল হতে না হতেই মাদক ব্যবসায়ীদের মেলায় পরিণত হয়েছে এই এলাকা।

বিজ্ঞাপন

মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প: ‘কী লাগবে বড় ভাই’


রোববার (২০ আগস্ট) সকাল ১০টা। কলেজ গেট থেকে গজনবী সড়ক ধরে জেনেভা ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যেতে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও সামনে যেতেই বাঁধে বিপত্তি। গজনবী সড়ক থেকে হাতের ডানদিকে জেনেভা ক্যাম্পের সড়কে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে প্রাপ্তবয়স্ক বিহারি যুবকদের। নির্দিষ্ট কিছু স্থানে দাড়িয়ে আছে তারা। যুবক বয়সী ছেলেদের দেখা পেলেই উচ্চস্বরে বলে ওঠছেন ‘কী লাগবে বড় ভাই’। তাদের এই ডাকে কিছু যুবককে সাড়া দিতেও দেখা গেছে।

এছাড়া রিকশাচালক, সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে তাদের ডাকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। আধা কিলোমিটার এলাকার এই জেনেভা ক্যাম্পে অন্তত ডজন খানেক মাদক ব্যবসায়ীর দেখা পান এই প্রতিবেদক। প্রতিবেদককেও মুখোমুখি হতে হয় ‘কী লাগবে বড় ভাই’ এমন ডাকের।

ভ্যানে সবজি বিক্রেতা স্থানীয় একজনকে ডাকার কারণ জানতে প্রশ্ন করা হলে তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, এরা সবাই গাঁজা বিক্রি করছে।

শুধুই কি গাঁজা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না এদের সাথে যোগাযোগ করলে সব ধরনের নেশা তারা ম্যানেজ করে দিতে পারে।



অন্য এক স্থানীয় বাসিন্দার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে বিহারি ক্যাম্পের অধিকাংশই গাঁজা-ইয়াবা বিক্রেতা। তাদের পেশা এই মাদক বিক্রি। এখানে তাদের কেউ কিছু বলার নেই। তারাই এখানকার সরকার। কেউ তাদের কিছু বললে তাকে মেরে ফেলবে। থানা পুলিশ কেউ তাদের কিছুই করতে পারে না।

এমনই অভিযোগ স্থানীয় অনেকের। তবে তাদের ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ প্রায় সবাই; নাম প্রকাশ তো প্রশ্নই আসে না!

এদিকে থানায় লোকবল সংকটে এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

গতকাল শনিবার গোলাগুলির ঘটনার পর মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার বলেন, এ ঘটনায় আমরা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি। তবে, আমাদের থানা হিসেবে লোকবল কম থাকায় কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায়ীদের গোলাগুলিতে শিশুসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহতরা হলেন- আমিন (২৭), শফিক (৩২) ও শিশু সাজ্জান (৮)। আহতদের উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।



সে সময় এলাকাবাসী বলেন, সন্ধ্যার সময় হঠাৎ করে জেনেভা ক্যাম্পের ভেতর ভয়াবহ গোলাগুলি শুরু হয়। যা অন্যান্য দিনের চেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। হঠাৎ গুলির শব্দে তাজমহল রোড, বাবর রোড ও হুমায়ন রোডের বাসিন্দারা ভয়ে এদিকসেদিক ছুটাছুটি শুরু করে। সন্ধ্যার পর থেকে গুলির শব্দে পুরো এলাকার দোকানপাট ও যান চলাচল থমকে যায়। সন্ধ্যা থেকে হওয়া সংঘর্ষ থেমে থেমে রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে জানান বাসিন্দারা।

সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কাউন্সিলর রাষ্ট্রনের মাধ্যমে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে রাইফেল, ককটেল বোমাসহ নানা ধরনের ভারী অস্ত্র দেন। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নানকের দেওয়া সেসব অবৈধ ভারী অস্ত্রের সাথে ৫ আগস্ট মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা থেকে লুট করা অস্ত্র দিয়ে গত দুই মাস যাবত মাদক ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ সংঘর্ষে চালিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকমাসে মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে চলা এসব সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং গুরতর আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

ভয়াবহ সংঘর্ষের পেছনে ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সোহের ওরফে বুনিয়া সোহেল, গালকাটা মনু, চুয়া সেলিম, আকরাম, শাহ আলম, পিচ্চি রাজা ও কলিম জাম্বুর মধ্যকার দন্দ্ব। তবে, ভয়াবহ এ সংঘর্ষ দীর্ঘদিন যাবত চললেও স্থানীয় থানা পুলিশ, র‍্যাব ও সেনাবাহিনীর শক্ত কোন পদক্ষেপ না থাকায় এ সংঘর্ষ দিন দিন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

Scroll to Top