মোবাইল অপারেটররা পাচ্ছে ডিডব্লিউডিএম যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি | চ্যানেল আই অনলাইন

মোবাইল অপারেটররা পাচ্ছে ডিডব্লিউডিএম যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি | চ্যানেল আই অনলাইন

মোবাইল নেটওয়ার্ককে অপটিক্যাল ফাইবারের সঙ্গে যুক্ত করার যন্ত্রই ডিডব্লিউডিএম মেশিন নামে পরিচিত। খুব শিগগিরিই মোবাইল অপারেটরদের ডিডব্লিউডিএম (ডেন্স ওয়েভলেন্থ ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং) যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

;

এই অনুমতি পেলে মোবাইল অপারেটররা প্রথমে নিজস্ব ট্রান্সমিশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ পাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর মত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে টেলিযোগাযোগ খাতে ট্রান্সমিশন ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেওয়া দেশী কোম্পানিগুলো বিলুপ্তির পথে চলে  যাবে। একইসঙ্গে  টেলিযোগাযোগ খাতে কয়েক হাজার বাংলাদেশী প্রকৌশলী ও কর্মীর বেকার হয়ে পড়ারও আশংকা রযেছে। এ ছাড়া টেলিযোগাযোগ খাত পুরোপুরি বিদেশী মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর কাছে কুক্ষিগত হয়ে পড়বে এবং এই খাতে  দেশী বিনিয়োগ কিংবা নতুন উদ্যেক্তা সৃষ্টির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

ফলে আপতত দৃষ্টিতে ইন্টারনেটের দাম কমার কথা বলা হলেও দ্রুতই দেশের পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিদেশী সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাবে। এর ফলে সিন্ডিকেট ইচ্ছেমত দাম নিয়ন্ত্রণেরও সুযোগ পাবে। ফলে ভবিষ্যতে ইন্টারনেটের দাম বাড়বে। দেশের ডাটা নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের আশংকার সৃষ্টি হবে, কারণ তখন দেশের সব ধরনের ডাটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে বিদেশী কোম্পানিগুলোর হাতে।

দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের ইতিহাসে দেখা যায়, ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে  দেশের তিনটি মোবাইল অপারেটর এবং ইন্টারেনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো একটটি বিদেশী মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটরের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিল। কারণ সে সময় ট্রান্সমিশন এবং ব্যান্ডউইথের পাইকাড়ি সরবরাহ একটি মোবাইল অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে সময় ট্রান্সমিশন সেবার জন্য এই একটি মোবাইল অপারেটরকে অপর দু’টি মোবাইল অপারেটর প্রতি সার্কিট ট্রান্সমিশন সেবার জন্য মাসে ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ পরিশোধ করত। আর প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ পরিবহনের জন্য ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হত।

এ ছাড়া  ভয়েস কলের জন্য আন্তঃসংযোগের ক্ষেত্রে ওই একক প্রভাবশালী অপারেটর অন্য তিনটি মোবাইল অপারেটরের জন্য মাত্র একশ’টি শেয়ারিং সার্কিট খোলা রাখত। ফলে ওই তিনটি অপারেটরের নেটওয়ার্ক থেকে প্রভাবশালী মোবাইল অপারেটরের নেটওযার্কে সংযোগ স্থাপন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ফলে সাধারণ অন্য তিনটি অপারেটরদের গ্রাহকরা প্রচণ্ড দুর্ভোগ পোহাতেন।

এর ফলে সারা দেশে ফাইবার অপটিক সেবাও সম্প্রসারণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে দেশে ডিজিটাল ডিভাইড বাড়ছিল। এ কারনেই ২০০৮ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী নীতিমালার মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে এমন একটি ভ্যালুচেন তৈরি করা হয়।

এই ভ্যালুচেনে ট্রান্সমিশন সেবায় কমন নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), আন্তসংযোগের জন্য ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স), পাইকাড়ি বাজারে ইন্টারনেট সরবরাহের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে এবং আন্তর্জাতিক ভয়েস কল টার্নিশেন সেবার জন্য আইজিডব্লিউ অপারেটরের লাইসেন্স দেওয়া হয়।

সে সময় নতুন নীতিমালার কারণে দেশীয় উদ্যেক্তারা ট্রান্সমিশন সেবা এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বিস্তৃত করার জন্য বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করে। ব্যাংক গ্যারান্টি নিশ্চিত করে লাইসেন্স গ্রহনের পর দেশব্যাপী ট্রান্সমিশনে সেবার কমন নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। এর ফলে  মোবাইল অপারেটরদের জন্য সার্কিট প্রতি ট্রান্সমিশন সেবার মূল্য ১৫ লাখ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকায়ে নেমে আসে। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ পরিবহন খরচ প্রতি এমবিপিএস ১০ হাজার টাকা থেকে ৩০০ টাকায় নেমে আসে। কমন ট্রন্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরির কারনে প্রভাবশালী মোবাইল অপারেটর টেলিযোগাযোগ খাতে একক আধিপত্য হারায়। যে কারনে ভয়েস কলের দাম ও প্রতি মিনিট সাত টাকা থেকে এক টাকায় নেমে আসে।

জানা যায়, ২০০৮ সালে বিটিআরসি টেলিযোগাযোগ খাতে কয়েকটি স্তরে সেবার জন্য পৃথক লাইসেন্স দেওয়ার কারনে  বৈষম্যহীন ভ্যালুচেন তৈরি হয়। এই ভ্যালুচেনে প্রতিটি সেবার জন্য গাইডলাইন তৈরি করা হয়। ট্রান্সমিশন সেবার ক্ষেত্রে প্রধান যন্ত্র হচ্ছে ডিডব্লিউডিএম। এই যন্ত্র ক্রয়, স্থাপন ও সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুমতি শুধুমাত্র ট্রান্সমিশন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে রাখা হয়। কারন ট্রান্সমিশন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ক্রেতা শুধুমাত্র মোবাইল অপারেটররাই। এখন মোবাইল অপারেটররা ডিডব্লিউডিএম ব্যবহারের সুযোগ পেলে দেশীয় ট্রান্সমিশন সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধান ক্রেতা হারাবে এবং তাদের প্রায় দেড় দশকের বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে।

এর ফলে দেশীয় ট্রান্সিমিশন ও ব্রডব্যান্ড সেবা দেওয়া কোম্পানিগুলোতে কর্মরত প্রকৌশলী ও কর্মী মিলে প্রায় দশ হাজার মানেুষের বেকার হয়ে পড়ার তীব্র আশংকা রয়েছে। বিগত বছলগুলোকে বিদেশী মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দফায় দফায় বাংলাদেশী প্রকৌশলী এবং কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়েছে। ফলে মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বর্তমানে বাংলাদেশী কর্মীদের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। এখন মোবাইল অপারেটররা ডিডব্লিউডিএম যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি পেলে টেলিযোগাযোগ খাতে বাংলাদেশী প্রকৌশলী ও কর্মীদের কাজের সুযোগ প্রায় আরও সংকুচিত হবে।

গত ১৫ বছরে দু’টি মোবাইল অপারেটর অপকৌশল প্রয়োগ করে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটারের বেশী ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এর অর্থ ট্রান্সমিশন ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসার জন্য অবৈধভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে মোবাইল অপারেটররা। তারা এখন এই বিনিয়োগের অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকে তুলতে চায়। এ ছাড়া বিদেশী মালিকানাধীন মোবাইল অপারটেররা গত প্রায় এক দশকে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ করেনি।

পতিত আওয়ামীলীগ সরকারের দুর্বল নীতির সুযোগে দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এবং বাংলাদেশে ব্যবসা থেকে আয় করা অর্থই নতুন করে বিনিয়োগ করেছে এই অবৈধ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য। এ বিষয়টি নিয়ে দেশীয় বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠানগুলো বার বার একটি টেকনিক্যাল অনুসন্ধানের দাবি জানালেও রহস্যজনক কারনে বিটিআরসি সেই অনুসন্ধান করেনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মোবাইল অপারেটরদের ডিডব্লিউডিএম যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার আগে বিটিআরসির একটি পূর্ণাঙ্গ টেকনিক্যাল অনুসন্ধান করা উচিত।

তাহলে বিদেশী মালিকানাধনী মোবাইল অপারেটরদের অবৈধ উপায়ে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক নির্মাণ, বিদেশী বিনিয়োগ না করা এবং লাভের হিসেবে গড়মিলের বিষয়টি উঠে আসবে। একই সঙ্গে ঘন ঘন কলড্রপ, ধীরগতির মোবাইল ইন্টারনেট সেবার রহস্যও উন্মোচিত হবে। এই অনুসন্ধানের পর বিদ্যমান ভ্যালুচেনে কার কি অবস্থান এবং অবদান তা সঠিকভাবে নির্ণয়ের পর স্বচ্ছতার সঙ্গে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে বিটিআরসির পক্ষে। তা না করে কেন তড়িঘড়ি মোবাইল অপারেটরদের ডিডব্লিউডিএম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত সার্কিভাবে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের জন্য আত্মঘাতী হবে বলেই সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

বিটিআরসি জানায়, গত এক দশক ধরে দফায় দফায় বিটিআরসি এনটিটিএন গাইডলাইন সংশোধনের জন্য উদ্যেগ নিয়েছে। কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের অসহযোগিতার কারনে সে উদ্যেগ বাস্তবায়িত হয়নি। কিভাবে গাইডলাইন সংশোধন হলে সব পক্ষের জন্য উপযোগ্য ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় এবং গ্রাহকদের আরও কমমূল্যে সেবা দেওয়া সম্ভব, সে বিষয়ে একটি সুপারিশমালঅও বিটিআরসি’র কাছে রয়েছে। তবে বিটিআরসি সেই সুপারিশমালা উপেক্ষা করে এর আগে অবকাঠামো ভাগাভাগি নীতিমালা তৈরির উদ্যেগ নেয়। তবে সমালোচনার মুখে সে উদ্যেগ ব্রর্থ হলে এখন নতুন কৌশলে মোবাইল অপারেটরদের ডিডব্লিউডিএম যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে ডাটা নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় ইস্যু। এ অবস্থায় প্রতিবেশী একাধিক দেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ট্রান্সমিশণ নেটওয়ার্কসহ দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে ডাটা প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতেই রাখেছে। কিন্তু ডিডব্লিউডিএম ব্যবহারের মাধ্যমে বিদেশী মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটরদের হাতে টেলিযোগাযোগ খাতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হলে তা ভবিষ্যতে দেশের ডাটা সুরক্ষার বিষয়টিও বড় ঝুঁকিতে ফেলবে।

Scroll to Top