মোগল স্থাপত্যের সাক্ষী: সাতমসজিদ রোডের প্রাচীন ঈদগাহ

মোগল স্থাপত্যের সাক্ষী: সাতমসজিদ রোডের প্রাচীন ঈদগাহ

ধানমন্ডির পুরোনো ১৫ ও নতুন ৮এ সড়কে, অর্থাৎ সাতমসজিদ রোড এলাকায় প্রাচীরবেষ্টিত মাঠটি মোগল ঈদগাহ। এটি ধানমন্ডি ঈদগাহ নামে বহুল পরিচিত। এই ঈদগাহ প্রায় ৪০০ বছর আগে শাহ সুজার আমলে তাঁর দেওয়ান মির আবুল কাসিম কর্তৃক নির্মিত।

মোগল স্থাপত্যের সাক্ষী: সাতমসজিদ রোডের প্রাচীন ঈদগাহ

রাজধানীর সাতমসজিদ রোডের মাঝামাঝি জায়গায় রাস্তার পূর্ব দিকে উঁচু ভূমির ওপর প্রাচীন স্থাপনাটি দেখা যায়। জিগাতলা থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে যেতে বড় রাস্তার পাশেই এটির অবস্থান। খানিকটা এগিয়ে গেলে দক্ষিণ পাশে রয়েছে বহু বছরের পুরোনো নিমগাছ ও তেঁতুলগাছ। উত্তর দিকের প্রাচীর বরাবর কয়েকটি মেহগনিগাছ আর নারকেলগাছ পশ্চিমের দেয়ালের পাশে। ভেতরের মাঠ সবুজ ঘাসে ঢাকা। এখানেই ৩৭৯ বছর ধরে ঈদের নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। এখন এটি ধানমন্ডির শাহি ঈদগাহ নামে পরিচিত।

কেন্দ্রীয় মিহরাবের ওপর স্থাপিত একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৬৪০ সালে ঈদগাহটি নির্মাণ করেছিলেন মির কাসিম। সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা ছিলেন তখন বাংলার সুবেদার। তাঁর দেওয়ান ছিলেন মির আবুল কাসিম। স্থানীয় লোকজন জানান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮১ সাল থেকে এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করছে। চারদিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর। তবে পশ্চিম দিকের প্রাচীরটিই কেবল মোগল আমলের। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৮ সালে সংস্কারের সময় অন্য তিন দিকের প্রাচীর নির্মাণ করে।

ধানমন্ডি ঈদগাহের দৈর্ঘ্য ১৪৫ ফুট ও প্রস্থে ১৩৭ ফুট। চার ফুট উঁচু করে ভূমির ওপর এটি নির্মিত হয় বন্যা থেকে রক্ষার জন্য। এর চার কোণে অষ্টাভূজাকৃতির বুরুজ রয়েছে। ঈদগাহের উত্তর পাশে আছে তিন ধাপের মিম্ব; ঈদগাহটি চারদিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তবে বর্তমানে কেবল পশ্চিম দিকের প্রাচীরটিই মোঘল আমলের। পশ্চিম প্রাচীরের মাঝবরাবর প্রধান মিহরাব। প্রধান মিহরাবের দুই দিকে আছে বহু খাঁজবিশিষ্ট নকশা করা প্যানেল। এ ছাড়া ছোট আকারের দুটি মেহরাব আছে এর দুই পাশে। মিহরাবগুলো দেয়ালের আয়তাকার ফ্রেমের ভেতরে অবস্থিত।

মোগল আমলে ঢাকার মূল অংশ ছিল আজকের পুরান ঢাকা। তাই এই ঈদগাহ ধারণা দিচ্ছে, এই অংশটি তখন উপশহর ছিল। ঢাকার ইতিহাসবিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, মোগল আমলে সুবেদার, নায়েবে নাজিম, অমাত্য ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এই ঈদগাহেই নামাজ আদায় করতেন। মূল শহর থেকে বেশ দূরে ছিল ঈদগাহটি। মূল শহর, অর্থাৎ পুরান ঢাকায় ছোট ছোট বেশ কয়েকটি সুলতানি ঈদগাহ থাকলেও বড় আকারের কোনো ঈদগাহ ছিল না। তাই মির আবুল কাসিম ঈদগাহের জন্য জায়গা খুঁজতে থাকেন। অবশেষে তিনি এ এলাকা বেছে নেন।

কাজেই মূল নগর থেকে কিছুটা দূরে খোলা জায়গায় এবং সাতমসজিদের কাছে হওয়ায় ধানমন্ডি এলাকায় ঈদগাহটি নির্মিত হয়। গবেষক ও লেখক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন, ‘এর পাশ দিয়ে তখন বয়ে যেত পাণ্ডু নদের একটি শাখা। এই শাখা জাফরাবাদে সাত গম্বুজ মসজিদের কাছে মিলিত হতো বুড়িগঙ্গার সঙ্গে।’

মোগল শাসক ও তাঁদের অমাত্যরা বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই বুড়িগঙ্গাপারের ঢাকা শহর থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরের এই ঈদগাহে আসতেন নামাজ আদায়ের জন্য। আমরা প্রাচীন থেকে বর্তমানে আসি। যা কিছু সমৃদ্ধ করে, তা ইতিহাস, ঐতিহ্য আর পুরাকীর্তি। শত বছর ধরে এমন স্থাপত্যই কালের সাক্ষী হয়ে ধরে রাখে সভ্যতা।

Scroll to Top