রাত পোহালেই (৭ জানুয়ারি) দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। সুষ্ঠু সুন্দরভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিএনপি এবং তাদের সহযোগীরা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে তারা। বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা নির্বাচনের বর্জনের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে বিধি মোতাবেক নির্বাচন হয়ে যাবে। নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি এবং সহযোগীরা দুদিনের হরতালের ডাক দিয়েছে।
তবে এবারের নির্বাচনে বিএনপি এবং তাদের সমর্থিত শরীক দল না থাকলেও মূলত জাতীয় পার্টি এবং হেভিওয়েট সব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে নির্বাচন নিয়ে জনগণের যথেষ্ট কৌতূহল রয়েছে। বিশেষ করে এবারের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের দুই অন্যতম নেতা, শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত বলে খ্যাত বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি’র ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। মেনন এবং ইনু জাতীয় পর্যায়ের এই দুই বড় নেতাকেই এবার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ দুজনই এর আগে সর্বশেষ তিনটি নির্বাচনে জয়ী হন। এর মধ্যে একটা বড় সময় ধরে দুজনই আবার মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকা ৮ (রমনা-মতিঝিল-পল্টন) থেকে সর্বশেষ তিনবার নির্বাচিত বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি। এবার বরিশাল-২ আসনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি এবার টানা তিনবারের বিজয়ী এমপি হিসেবে চতুর্থবারের মতো কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনে জোটের নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষিত এই দুই নেতাকেই এবার আওয়ামী লীগ থেকে আগত দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবে সর্বশেষ স্বতন্ত্র প্রার্থী, সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম কয়েকদিন আগে রাশেদ খান মেনন এমপির পক্ষে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এতে করে রাশেদ খান মেননের অবস্থান কিছুটা হলেও সুদৃঢ় হয়েছে। এখন তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তথা আওয়ামী লীগ নেতা ফাইয়াজুল হককে মোকাবিলা করতে হবে। মনিরুল ইসলাম সরে দাঁড়ানোর কারণে রাশেদ খান মেনন এখন স্বস্তিতেই আছেন। এরপরও ভোটের ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত কোনো অনুমানকে অগ্রাহ্য করা সঠিক হবে না।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের চেয়ে তুলনামূলক বেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি। কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফীন। শুরু থেকেই তিনি হাসানুল হক ইনু এমপি’র বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে বেড়ালেও জোট থেকে তাকে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। প্রচার-প্রচারণার সময় কামারুল আরেফীন পথে-ঘাটে সর্বত্র শক্তি প্রয়োগের মহড়া দিয়েছেন, অবান্তর অরাজনৈতিক কথাবার্তা বলেছেন। হাসানুল হক ইনুকে এলাকায় ঢুকতে দেবেন না এমন কথাও বলেছেন।

বিগত দিনে আওয়ামী লীগ এবং জাসদের দ্বন্ধের অভিমানে কামারুলের সাথে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের বড় অংশ সক্রিয় রয়েছেন। তাদের কথাবার্তা এবং বক্তব্যের মাঝে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে-যেভাবেই হোক ইনুকে হারাতে হবে। এই আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ তারা সর্বত্র ঘটিয়েছেন। বিপরীতে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বারবার বলেছেন তিনি এক টাকারও দুর্নীতি করেননি, সংসদীয় এলাকায় উন্নয়ন করেছেন, তিনি সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাধারণ ব্যবসায়ীসহ কোনো মানুষকে কখনও চাঁদা দিতে হয়নি। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে শুরু করে কোনো মানুষ সাধারণ মানুষের শান্তি কেড়ে নিতে পারেননি। হাসানুল হক ইনু এমপি বলেছেন, এটিই তার শক্তি। তিনি এও বলেছেন, তার সংসদীয় এলাকায় আওয়ামী লীগ ও জাসদ দুই ভাই। এদিকে হাসানুল হক ইনু এমপি নৌকা পেলেও কামারুলের ট্রাক প্রতীক নিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছেন বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা হাসানুল হক ইনুর বিপক্ষে কাজ করেছে। মিরপুর ও ভেড়ামারার আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এক অংশের নেতাকর্মীকে নৌকা প্রতীককে অশ্রদ্ধা দেখানোর কারণে এই আসনের লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হবে বলে অনুমিত হচ্ছে।
জাতীয় পর্যায়ে জোট এবং ভোটের রাজনীতিতে এখনও এগিয়ে আছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরনো অনেক মিত্র এবং তার হাতে গড়া অনেক নেতা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও ১৪ দলীয় জোটের মিত্রদের তিনি এখনও একই সুতোয় বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। নানা জটিলতার মধ্যেও ১৪ দলীয় জোটের শরীকরা তার সিদ্ধান্তের বাইরে যাননি। জোটের অন্যতম দুই নেতা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্র্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি’র কারণেই অবশ্য এটি সম্ভব হয়েছে। কিছু বিষয়ে মনোমালিন্য থাকা স্বত্ত্বেও জোটের স্বার্থে আওয়ামী লীগ নেত্রীর প্রতি এবারও পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই জোট থেকে প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্র্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এটি সত্য এই দুই নেতা না থাকলে ১৪ দলীয় জোট অনেক আগেই মাটির নিচে চলে যেত।
হাসানুল হক ইনু জাসদের প্রতিষ্ঠাকালীন তরুণদেরই একজন। যিনি ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম দিকনির্দেশক। জঙ্গীবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার। ২০০১ সাল থেকে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ একক ও নিরলস প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দলের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা পরিচালনা করে এবং ‘জাতীয় ঐকমত্য’-এর ভিত্তিতে ‘ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন ও ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ পরিচালনা’র রাজনৈতিক আবশ্যিকতার গুরুত্ব তুলে ধরে। এ সময় সারা দেশে বিএনপির সমর্থনে শক্তিশালী হয়ে ওঠে অনেক জঙ্গিগোষ্ঠী; গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তির ওপর হামলা পরিচালনা করতে থাকে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালাতে থাকে, এমনকি বিরোধী দলীয় নেতাকে হত্যার লক্ষ্যে তার ওপর গ্রেনেড হামলা পরিচালনা করে। এ সময় ‘একলা চল’ নীতির বিপরীতে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আরও নিবিড়ভাবে অনুভূত হয়। অবশেষে ২০০৫ সালে গঠিত হয় ‘১৪ দল’। এর আগে জাসদ প্রস্তাবিত ‘ন্যূনতম জাতীয় কর্মসূচি: পরিবর্তনের রূপরেখা ও অঙ্গীকার’-এর ভিত্তিতেই প্রণীত হয় ১৪ দলের ২৩ দফা। ১৪ দল গঠনে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পরবর্তী নির্বাচনে ১৪ দলের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হয়।
রাজনীতির ময়দানে ইনু-মেননকে নিয়ে কম কথা হয়নি। এখনও সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্যদের অনেকেই এই দুই নেতার ওপর এক হাত নিতে ভুল করেন না। শেখ হাসিনার কাছ থেকে ইনু-মেনন এ দুজনকে বিচ্ছিন্ন করতে যড়যন্ত্রও কম হয়নি। কিন্তু ইনু-মেননরা স্বাধীনতার স্বপক্ষের জোটকে অটুট ও ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী রেখেছেন। জোট ও ভোটের রাজনীতিতে ইনু-মেননদের বিশ্বস্ততা, দৃঢ়তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের এক অংশের নেতা কর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর তকমা লাগিয়ে এই দুই নেতাকে হারানোর জন্য পরিকল্পনা করেছে সেটা দেশের জন্য মোটেও মঙ্গল বয়ে আনবে না। এ কথা সত্য একজন কামারুল আরেফিরেন মিরপুর ও ভেড়ামারার বাইরে দুই পয়সা মূল্য নেই। কোনো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কথা বলার যোগ্যতা তিনি অর্জন করেন নাই।
বরিশাল এবং কুষ্টিয়ার মাঠের আওয়ামী লীগের একটি স্বার্থান্বেষি গ্রুপের ষড়যন্ত্র, অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্তের কারণে ভোটের লড়াই-এ যদি ১৪ দলীয় জোটের দুই দিকপাল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি পরাজিত হন তাহলে সেটা শেখ হাসিনার জন্য মোটেও সুখপ্রদ হবে না। এ দুজন পরাজিত হলে হয়ত অনেকেই সুখ খুঁজবেন, হাসি-তামাশা করবেন, সোশাল মিডিয়াতে ঘৃণা ও বিদ্ধেষ ছড়াবেন কিন্তু ১৪ দলীয় জোটের জন্য সেটা মোটেও শুভ কিছু হবে না। শেখ হাসিনার মতো একজন নেতা থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাই বুঝতে পারেন না, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা কত ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আর মেনন-ইনু না থাকলে শেখ হাসিনা রাজনীতির ময়দানে একা হয়ে পড়বেন। হয়ত এখন তা আঁচ করা যাবে না, অনেকেই বুঝতেও চাইবেন না। কিন্তু সময় হলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)