মা আনন্দময়ী: বাংলার যে নারী সাধকের প্রভাব বিশ্বজোড়া | চ্যানেল আই অনলাইন

মা আনন্দময়ী: বাংলার যে নারী সাধকের প্রভাব বিশ্বজোড়া | চ্যানেল আই অনলাইন

আজ তার জন্মদিন! ১৮৯৬ সালের ৩০ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খেওড়া গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। মুখটি যে মনোহর ছিল তা ছোটবেলার নামেই প্রমাণ। নির্মলা সুন্দরী! এই নির্মলাই একদিন জগৎবিখ্যাত হন মা আনন্দময়ী নামে।

আনন্দময়ী ছিলেন এক অসাধারণ আধ্যাত্মিক সাধক। বাংলার এই নারী আধ্যাত্মগুরুর দর্শন ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনমানসে আত্মিক জাগরণে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

আনন্দময়ীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট এই যে তিনি নিদির্ষ্ট ধর্ম, গোত্র বা সম্প্রদায়কে অনুসরণ না করে সার্বজনীন আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সাধনার দুনিয়ায় খুঁজে নিয়েছেন নিজের স্বতন্ত্র পথ। আত্মসাধনার সেই পথ ধরে লাভ করেছিলেন আত্মসিদ্ধি।

আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানীদের কাছে তাই তিনি বিশেষ অনুপ্রেরণার। নারী সাধক হিসেবে তার আধ্যাত্মিক অবস্থান অনেক নারীকে জুগিয়েছে সাহস ও অনুপ্রেরণা। পরমহংস যোগানন্দ, স্বামী শিবানন্দসহ বহু সাধক ও অনুসারীকে অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি। নেহরু পরিবারসহ বহু ভারতীয় নেতাও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

তার আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও মোহময় ব্যক্তিত্ব পশ্চিমা বিশ্বেও বিপুল সমাদর পায়। ষাট ও সত্তরের দশকে পূর্বের আধ্যাত্ম দশর্নের অন্যতম প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। তার জীবনী, উপদেশ ও কথোপকথন অনুদিত হয়েছে ইংরেজি, জার্মান, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায়।

ঢাকায় তার গড়ে তোলা আশ্রম আজও রয়েছে। এছাড়াও ভারতের কাশী, কনকল, হরিদ্বারসহ বিভিন্ন দেশে তার নামে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আশ্রম ও বিদ্যাপীঠ, কন্যাপীঠ, হাসপাতাল।

মা আনন্দময়ীর পৈত্রিক নিবাস ছিল নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকূট গ্রামে। বাবা বিপিনিবিহারী ভট্টাচার্য, মা মোক্ষদা দেবী। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার ছায়া দেখা যায়। শৈশব কাটে খেওড়া ও মামাবাড়ি সুলতানপুরে। মাত্র দুই বছর বয়সে, মায়ের কোলে বসে কীর্তন শুনে আত্মভোলা হয়ে যেতেন নির্মলা। এ যেন তার ভিন্নধর্মী মানসিক গঠনেরই ইঙ্গিত। নির্মলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল প্রায় অনুপস্থিত। তবে তার চেতনা ও উপলব্ধি ছিল গভীর। ১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে খেওড়ায় মাত্র ১২ বছর ১০ মাস বয়সে তার বিয়ে হয় বিক্রমপুরের রমণীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে। রমনী মোহনের চাকরিসূত্রে তিনি অষ্টগ্রামে আবাস গড়েন ১৯১৫ সালে। তার হাসিমুখ, সৌম্য দর্শনে মানুষ তাকে ডাকত ‘খুশির মা’ নামে।

পরে রমনীমোহনের বদলির কারণে নির্মলা ফিরে আসেন বিদ্যাকূটে তার বাবার বাড়িতে। সেখানে তিন বছর থাকেন।
১৯১৮ সালে বাজিতপুরে অবস্থানকালে ২২ বছর বয়সে তিনি প্রকাশ করতে থাকেন বিভিন্ন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ও অলৌকিক লীলা। আত্মসাধনার পর ১৯২২ সালের আগস্ট মাসের পূর্ণিমা রাতে আত্মদীক্ষা লাভ করেন। বাজিতপুরে এ ঘটনার কয়েক মাস পর এক ভাই যখন তাকে জিজ্ঞেস করে তুমি কে? আনন্দময়ী উত্তর দেন, পূর্ণ ব্রহ্মা নারায়ণ। একই বছর ডিসেম্বরে রমনীমোহন তার কাছে দীক্ষা নিয়ে নতুন নাম নেন-ভোলানাথ।

দু’বছর পর, ১৯২৪ সালে রমণীমোহন ঢাকার নবাবের বাগানের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। নির্মলাও তার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। সেসময় শাহবাগ ও রমনা কালী মন্দিরের আঙিনা হয়ে ওঠে তার বিচরণক্ষেত্র। ১৯২৬ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে প্রায় পাঁচশ বছর প্রাচীন কালীমন্দিরের পাশে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

সেখানেই একদিন সাধনার সময় আধ্যাত্মিকভাবে উন্মোচিত হন নির্মলা—আনন্দময়ী মা রূপে। শুরু হয় মানুষের মাঝে তার প্রসার ও ভক্তির পথ চলা। ঢাকার এই আশ্রমকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে তা্র ভক্তদের মিলনকেন্দ্র। এই মন্দিরের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভক্তদের কাছে। শাহবাগে ফকির মায়ের সমাধিতেও মা আনন্দময়ীর পদচারণার উল্লেখ পাওয়া যায়।

১৯২৭ সালে তিনি ভারতের হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় যোগ দেন। সেখানে তার আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা ও ভাবধারায় অনেক গুণীজন আকৃষ্ট হন। তাদের মধ্যে ছিলেন গোপীনাথ কবিরাজ, ডা. ত্রিগুণা সেন, নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

১৯২৯ সালে সিদ্ধেশ্বরীতে তার সাথে দেখা করেন বিখ্যাত ভাওয়াল সন্ন্যাসী। সেই সাক্ষাতে তার সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের প্রার্থনা জানান। ১৯৩২ সালে আনন্দময়ী ও ভোলানাথ উত্তর ভারতের দেরাদুনে চলে যান। সেখান থেকে তিনি ভারতব্যাপী আধ্যাত্মিক জাগরণে নিজেকে নিবেদন করেন।

নৃত্য সম্পর্কে তার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল অনন্য। তিনি বলতেন, ‘জগৎটাই নৃত্যময়; জীবের মধ্যে যে প্রাণের স্পন্দন, এমনকি বীজ থেকে যখন অঙ্কুরোদ্গম হয় তখন সেখানেও এক ধরনের তরঙ্গময় নৃত্যের সৃষ্টি হয়। এ তরঙ্গরূপ নৃত্য যে মূল থেকে উদ্ভূত হয়, একসময় স্তিমিত হয়ে আবার সে মূলেই মিলিয়ে যায়।’ তার মতে, এই তরঙ্গই জীবাত্মা ও পরমাত্মার অন্তনির্হিত সম্পর্ককে নির্দেশ করে।

১৯৩৭ সালে তিনি কৈলাস পর্বত যাত্রা করেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু তার সাথে দেখা করেন। এছাড়া নৈমিষারণ্যের মতো ভারতের বহু পুরনো তীর্থস্থানে গিয়ে মন্দির স্থাপন এবং যজ্ঞ, কীর্তন, নাচ-গান ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি তা পুনরুজ্জীবিত করেন।

মা আনন্দময়ীর জীবনের মূল বাণী ছিল অত্যন্ত সরল অথচ গভীর। তিনি বলতেন, ‘সংসারটা ভগবানের; যে যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় থেকে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া মানুষের কর্তব্য।’

১৯৮২ সালের ২৭ আগস্ট মা আনন্দময়ী মহাপ্রয়াণ করেন। তার মরদেহ উত্তর ভারতের হরিদ্বারের কনখল আশ্রমে গঙ্গাতীরে সমাধিস্থ করা হয়। সমাধি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও।
আধ্যাত্মিক সাধনা, মানবপ্রেম, সহজ জীবনচর্চায় মা আনন্দময়ী আজও অগণিত মানুষের জন্য প্রেরণার এক অফুরান উৎস।

(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Scroll to Top