মাদ্রাসায় ‘অস্ত্র হাতে’ সেই ভিডিওর বিষয়ে যা জানাল রিউমার স্ক্যানার

মাদ্রাসায় ‘অস্ত্র হাতে’ সেই ভিডিওর বিষয়ে যা জানাল রিউমার স্ক্যানার

জুমবাংলা ডেস্ক : যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় বার্ষিক প্রতিযোগিতায় ছাত্রদের পারফরম্যান্সের একটি ভিডিওকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, সমাবেশ বা জিহাদের আহ্বান হিসেবে মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানার।

মাদ্রাসায় ‘অস্ত্র হাতে’ সেই ভিডিওর বিষয়ে যা জানাল রিউমার স্ক্যানার

সংস্থাটির অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, যশোরের জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় একটি প্রতিযোগিতার ভিডিওকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রচারণা হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।

বৃহস্পতিবার তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে, ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা বলেছে- সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি কাপড় দিয়ে চেহারা ঢেকে আরবি ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন এবং তার দুই পাশে অস্ত্রসদৃশ বস্তু নিয়ে মুখ ঢেকে আরও দুজন কালো পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন। ওই ভিডিওটি প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে এবং জিহাদের ডাক দেওয়া হয়েছে।

ওই ভিডিওটিতে প্রদর্শিত ব্যক্তিরা আইএস’র বেশে উগ্রবাদ প্রচারকারী বা জঙ্গি দাবিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন। সজীব ওয়াজেদের পোস্টটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও শেয়ার করা হয়েছে। এ ছাড়া ভিডিওটিতে জিহাদের ডাক দেওয়া হয়েছে দাবিতে লেখিকা তসলিমা নাসরিনও তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ভিডিওটি পোস্ট করেছেন।মাদ্রাসায় ‘অস্ত্র হাতে’ সেই ভিডিওর বিষয়ে যা জানাল রিউমার স্ক্যানার

পাশাপাশি ভিডিওটি রিপাবলিক বাংলা, টিভি৯ বাংলাসহ পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমে প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, ভিডিওটিতে বাংলাদেশে অস্ত্র হাতে জঙ্গিদের সভা ও জিহাদের ডাক প্রদর্শিত হয়েছে।

রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটির সঙ্গে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান, সমাবেশ বা জিহাদের ডাকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। প্রকৃতপক্ষে এটি ‘যশোর জামিয়া ইসলামিয়া’ নামের মাদ্রাসার বার্ষিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের একটি অভিনয় বা প্রদর্শনীর দৃশ্য।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে মঞ্চের পেছনের অংশে থাকা ব্যানারে ‘যশোর জামিয়া ইসলামিয়া’ লেখা দেখা যায়। এই সূত্র ধরে অনুসন্ধানে ‘এইচ এম আব্দুল্লাহ যশোর’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গত ১৭ ডিসেম্বরে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়, যা ফেসবুকে এই ভিডিওর প্রথম প্রচারিত সংস্করণ বলে প্রতীয়মান হয়।

ভিডিওটির ক্যাপশনে বলা হয়, ‘যশোর জামিয়া ইসলামিয়া। বার্ষিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান-২০২৪। আরবি বক্তৃতা…সবাইকে দেখার অনুরোধ রইলো’।

ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্টটির বায়ো পর্যবেক্ষণে জানা যায়, অ্যাকাউন্টধারী নিজেকে যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের সহকারী জিম্মাদার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে যশোর জামিয়া ইসলামিয়ার ফেসবুক পেজেরও সন্ধান পাওয়া যায়।

ফেসবুক পেজটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ১৮ ডিসেম্বর একটি ফেসবুক লাইভ সম্প্রচারে আলোচিত বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকি। তিনি জানান, প্রচারিত ভিডিওটি গত ১৭ ডিসেম্বর যশোর জামিয়া ইসলামিয়ার বাৎসরিক আঞ্জুমান অর্থাৎ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ভিডিও, যার সঙ্গে জঙ্গিবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরও জানান, হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র সদৃশ বস্তুটিও আসল আগ্নেয়াস্ত্র নয় বরং শোলা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

এ ছাড়া ওই ফেসবুক পেজে যশোর জামিয়া ইসলামিয়ায় বার্ষিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের একটি পোস্টার গত ১৫ ডিসেম্বরে শেয়ার করা হয়েছে। তবে অনুষ্ঠানটির নির্দিষ্ট তারিখ পোস্টারটিতে উল্লেখ করা হয়নি।

বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তর জানতে রিউমার স্ক্যানার যোগাযোগ করে যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মাগফুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রচারিত ভিডিওটি গত ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বরে ছাত্রদের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের। এ জায়গায় হামদ, নাত, ক্বিরাত, হিফজুল প্রতিযোগিতা, বাংলা ও আরবি বক্তৃতা, ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’-এসব বিভিন্ন বিষয়ে প্রদর্শনী হয়েছে। প্রচারিত ভিডিওটি এরকমই একটি প্রদর্শনীর অংশ ছিল। প্রদর্শনীটির প্রেক্ষাপট ছিল বর্তমান ইসরাইল ও ফিলিস্তিন পরিস্থিতি। ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা করছে এবং নারী, শিশু, অসহায়, বৃদ্ধদের হত্যা করছে। ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে। এসব বিষয়ে ছাত্রটি আরবিতে বক্তৃতা দিয়েছে। ছাত্রটি বলেছে, অসহায় দরিদ্র এসব মা-বোনের যাতে ইজ্জত নষ্ট না হয়, তারা যেন আর না মরে। আমরা মুসলমানরা যেন তাদের প্রতি সোচ্চার থাকি। এ বিষয়ে প্রচারিত দাবিটি ভুয়া এবং তা থানা থেকে এসেও ইতোমধ্যে যাচাই করা হয়েছে।

পাশাপাশি মুফতি মাগফুর রহমানের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ‘মুফতি মাগফুর রহমান যশোরী’ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, গত ১৭ ডিসেম্বরে একই মঞ্চ থেকে ওই অনুষ্ঠানের একাধিক লাইভ ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। তার মধ্যে কিছু পোস্টে মঞ্চের পেছনের ব্যানারের পুরো লেখাটিও দৃশ্যমান হয়েছে।

এদিকে ভিডিওটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে প্রচারিত ভিডিওটি ভুয়া দাবি করে মন্তব্য করেন যশোর কোতয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাক।

পরবর্তীতে এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার যশোর জেলা পুলিশ তাদের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও প্রচার করেছে।

পোস্টটি থেকে জানা যায়, ‘আলোচিত ভিডিওটির বিষয়ে যশোর জেলা পুলিশের একাধিক টিম অনুসন্ধানে জেনেছে যে, গত ১৭ ডিসেম্বর ওই মাদ্রাসায় বার্ষিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান-২০২৪ এর প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে অত্র প্রতিষ্ঠানের তিনজন ছাত্র ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং এই ভিডিওটি তারই অংশ।

যশোর জেলা পুলিশ ওই মাদ্রাসায় সরেজমিনে পরিদর্শন করে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র সদৃশ বস্তু দেখতে পায়, যা কর্কশিট ও কাঠ দিয়ে তৈরি। সুতরাং যশোরের জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার একটি প্রতিযোগিতার প্রদর্শনীর ভিডিওকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রচারণা হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।

Scroll to Top