ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন (মসিক) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উচ্ছ্বাস আর আনন্দের জোয়ারে ভাসছেন নগরীর ভোটাররা। মিছিল, মিটিং, গানে, স্লোগানে, মাইকে চলছে প্রচারণা। মোড়ে মোড়ে ক্যাম্পিং, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা, লিফলেট হাতে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অবিরাম ছুটে চলা, সব মিলিয়ে ময়মনসিংহ এখন ভোটের কলরবে দিনরাত জেগে থাকা এক নগরীতে পরিণত হয়েছে।
ভোটের বাকি আর মাত্র একদিন। বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) শেষ হবে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। সে কারণে ভোটারদের সমর্থন পেতে প্রার্থীরা শেষ মুহূর্তে বিরামহীন দৌঁড়ঝাপ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। অন্যদিকে, ভোটাররাও বেশ আগ্রহভরে অপেক্ষা করছেন, ভোটের দিনের জন্য। সেইসঙ্গে সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি থাকার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় একদিকে যেমন গতি পেয়েছে প্রচার-প্রচারণা, তেমনি নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের পক্ষ-প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধামকির কারণে কোথাও কোথাও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। এসব ঘটনায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা ধরনের শঙ্কা।
এবার নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে অন্য কোনো দলের কোনো প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসেননি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক না দিয়ে নির্বাচনকে উন্মুক্ত ঘোষণা করায় দলটি থেকে একাধিক নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন।
সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু দেয়াল ঘড়ি প্রতীক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেসামুল আলম ঘোড়া প্রতীক, শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদেকুল হক খান মিল্কী টজু হাতি প্রতীক এবং কৃষক লীগ নেতা কৃষিবিদ ড. রেজাউল হক হরিণ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অপরদিকে, জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে শহীদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল লড়ছেন দলীয় প্রতীক লাঙল নিয়ে।
ভোটের মাঠের প্রচার-প্রচারণা ও আলোচনা, সমালোচনায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। অনেকেই মনে করছেন, শেষপর্যন্ত বর্তমান মেয়র ইকরামুল হক টিটুর দেয়াল ঘড়ি ও আওয়ামী লীগ নেতা সাদেকুল হক মিল্কি টজুর হাতি প্রতীকের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।
তবে বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো নির্বাচনে না আসায় ভোটের মাঠে এন্টি-আওয়ামী লীগ বলয়ের ভোট এবং নীরবে থাকা সাধারণ ভোটগুলো একটা বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। বিএনপি বা আওয়ামীবিরোধী ভোটারদের কতজন ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হবেন সেটিও একটি বড় বিষয়। তবে কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় ওই সব ভোটারদের একটা অংশ কেন্দ্রে উপস্থিত হবেন বলে ধারণা করছেন অনেকেই।
এদিকে, ভোটারদের মন বাগাতে প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে, আলাদা আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে উল্লেখযোগ্য মেয়র প্রার্থীরা তাদের নিজ নিজ নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছেন।
পাঁচজন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের চারজন প্রার্থী ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বহু দফা প্রতিশ্রুতি সংবলিত নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছেন।
এর মধ্যে ময়মনসিংহ সিটি আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাতি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাদেকুল হক খান মিল্কী টজু গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৫ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজ কর্মপরিকল্পনার ইশতেহার ঘোষণা করেছেন।
এরপর গত ২ মার্চ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোড়া প্রতীকের মেয়র প্রার্থী এহতেশামুল আলম ২০ দফা প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেন।
তার একদিন পর ৩ মার্চ ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আরেক সংবাদ সম্মেলন ডেকে সদ্য সাবেক মেয়র ও টেবিল ঘড়ি প্রতীকের মেয়রপ্রার্থী ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু ২৩ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেন।
নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য মেয়র প্রার্থীরা নগরবাসীকে যেভাবে সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, সেটি তাদের পক্ষে কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব কিংবা তাদের সক্ষমতা কতটুকু, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে নগরের সচেতন সমাজের মনে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত বলেন, সস্তা বাহবা ও ভোটারদের মন কাড়তে নির্বাচনের মাঠে বহু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে শেষপর্যন্ত তার কতখানি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, সেটা দেশের সব মানুষেরই জানা। ভোট এলে সব সময়ই এমন প্রতিশ্রুতি মানুষ পান কিন্তু তার বাস্তবায়ন সামান্যই দেখাতে পান তারা।
অন্যদিকে, মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীরাও থেমে নেই। তারাও প্রচার-প্রচারণা চালাতে গিয়ে ভোটারদের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যে সমস্ত কাজ কাউন্সিলরদের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, নির্বাচিত হলে সেগুলোও বাস্তবায়ন করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
এদিকে, বিভিন্ন ওয়ার্ডে একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় নানাভাবে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। একাধিক ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনি ক্যাম্পে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগও রয়েছে।
প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) দেয়াল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী ইকরামুল হক টিটু নগরীর বিদ্যাময়ী স্কুল এলাকা, কলেজ রোড, নওমহল, নাহার রোড, সানকিপাড়া এলাকায় কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগ চালিয়েছেন।
হাতি প্রতীকের প্রার্থী সাদেকুল হক খান টজু মিল্কি চরপাড়াসহ আশপাশের এলাকায়, ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী এহতেসামুল আলম ব্রিজ মোড়, র্যালির মোড়সহ আশপাশের এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। এছাড়া অন্যান্য প্রার্থীরা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ ও ভোট প্রার্থনা করেছেন।
ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী এহতেশামুল আলম বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ ভালো থাকবে। আচরণবিধি মেনেই আমরা কাজ করছি। নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন উপহার দিয়েছে, যা সারা পৃথিবী স্বাগত জানিয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সৎ যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে। ‘স্মার্টসিটি’ নির্মাণে সিটি অ্যাপের প্রচলন, যানজট নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা এবং নগরীর অভ্যন্তরে ওয়ানওয়ে রোড বাস্তবায়ন, নগরে অভ্যন্তরে গণপরিবহনে টেকসই সমাধান এবং বেকার যুবকদের জন্য আমি কাজ করতে চাই। সিটিতে যে সমস্ত খাস জমি রয়েছে, ওইখানে কুটির শিল্পের ব্যবস্থা করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবো।
জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীকের প্রার্থী শহিদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল বলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হবে। আর এখানে জাতীয় পার্টির বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমিই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
হাতি প্রতীকের প্রার্থী সাদিকুল হক খান মিল্কী বলেন, পরিচ্ছন্ন ও যানজটমুক্ত নগরী গড়তে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি জয়ী হলে সুন্দর একটি নগরী গড়ে তুলবো। সেজন্য নগরবাসী আমাকেই বেছে নেবেন বলে আশাবাদী।
ঘড়ি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী ইকরামুল হক টিটু বলেন, উন্নয়নের অসমাপ্ত কাজ করতে নগরবাসী আবারও আমার ঘড়ি প্রতীকে আস্থা রাখবেন। বিগত পাঁচ বছরে বৈশ্বিক সংকটের কারণে শতভাগ উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। সাধারণ মানুষ আমার প্রতি তাদের সমর্থন দিলে চলমান উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করতে পারবো। সাধারণ জনতার পাশাপাশি নেতাকর্মীরাও আমার সঙ্গে রয়েছেন। আশা রাখছি, জয় সহজেই আসবে।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রার্থীদের সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ শান্ত ও স্বাভাবিক রয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসন সব সময় সতর্ক অবস্থানে আছে বলেও জানান তিনি।
ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩২ পুরুষ। ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৫ নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৯ জন। তারা আগামী শনিবার (৯ মার্চ) ইভিএমে ১২৮ কেন্দ্রে ভোট দেবেন। মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থী ছাড়াও নগরের ৩৩টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ১৪৯ জন এবং ১১টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থী আছেন ৬৯ জন। নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ফরহাদ আলম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ায় কাউন্সিলর পদে ৩২টি ওয়ার্ডে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।