প্রতিদিন মশার কয়েল ব্যবহার করা আমাদের খুব সাধারণ একটি অভ্যাস। মশার উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহজ সমাধান হিসেবে আমরা বাসায় সন্ধ্যা হলেই কয়েল জ্বালিয়ে ফেলি। অভ্যাসবশত এই কাজ করার সময় একবার ভেবেও দেখি না, মশার কয়েল আমাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে।
আবার অনেক সময় এটিকে সহজ ও সাশ্রয়ী উপায় হিসেবে ভেবে নিয়ে মশার কয়েলের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ততোটা মাথা ঘামাই না। আবার, আমরা মশার কয়েলের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখেও বিভ্রান্ত হতে পারি।
আমাদের আসলে মশার কয়েলের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা করতে দেখা যায় না। মশার কয়েলে থাকা অত্যন্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে মানুষের শরীরে নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই কারণে, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ থেকে শুরু করে নানারকম স্বাস্থ্যগত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে মানুষ।
বিশেষ করে, শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী, অথবা আগে থেকেই জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষেরা এক্ষেত্রে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ছোট ও ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় দীর্ঘসময় কয়েল জ্বালানোর কারণে এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও, মাত্র একটি কয়েল থেকেই ৭৫-১৩৭ টি জ্বলন্ত সিগারেটের সমান ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হতে পারে।
বলা চলে, আমরা মশা থেকে বাঁচতে গিয়ে কয়েলের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে আরও নানারকম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। আবার অন্যদিকে, সারারাত ধরে জ্বলতে থাকা মশার কয়েল থেকে খুব সহজেই অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মশার কয়েল খোলা অবস্থায় জ্বলতে থাকে।
অনেক সময়, অসাবধানতাবশত এগুলো পর্দা, কাপড়, বিছানার চাদর বা কাঠের আসবাবপত্রের খুব কাছে রাখা হয়; যেখান থেকে খুব সহজেই আগুন লেগে যেতে পারে। কাপড় বা কাঠে যেহেতু দ্রুত আগুন লাগে ও ছড়িয়ে পড়ে; সেক্ষেত্রে এই আগুন থেকে খুব সহজেই মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, মশার কয়েল থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশে প্রতিবছর বাড়ছে; এমনকি কিছু জায়গায় মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও এই কারণ রয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাবাজারে এরকম মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মশার কয়েল বা জ্বলন্ত সিগারেট থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এই আগুনের কারণে মাত্র একরাতের মধ্যে প্রায় পৌনে ৪ হাজার দোকান ভস্মীভূত হয়ে যায়, যার মোট আর্থিক ক্ষতি প্রায় ২৮৮ কোটি টাকা।
যেসব বাসায় শিশু রয়েছে সেখানে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা আরও অনেক বেশি থাকে। বিশেষ করে, খোলা থাকায় আগুন বা শলাকার প্রতি শিশুরা খুব সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়তে পারে। বাড়িতে কোনো শিশু থাকলে তারা মেঝেতে থাকা মশার জ্বলন্ত কয়েল গিয়ে ধরতে পারে।
অসাবধানতা বা অসতর্কতাবশত শিশুরা কয়েলে হাত দিয়ে নিজের ক্ষতি করতে পারে। কখনও কয়েল আটকানো কোনো পাত্রে থাকলেও তা শিশুরা উলটে দিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডজনিত পোড়া একটি অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি যেসমস্ত বাসাবাড়িতে পোষা প্রাণি রয়েছে, সেখানেও এই একই ধরনের ঝুঁকি রয়ে যাচ্ছে।
এখন, মশার কয়েলের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে নিজেকে, পরিবারকে ও বাসাবাড়িকে মুক্ত রাখতে কয়েলের বিকল্প ও নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, নন-ফ্ল্যামেবল (অদাহ্য) বিকল্প যেমন, ইলেকট্রিক লিকুইড ভ্যাপোরাইজার ব্যবহার করলে স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও অগ্নিকাণ্ডের বিপদ এই দুটি থেকেই মুক্ত থাকা সম্ভব।
মশার কয়েলের ক্ষতিকর দিক নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছেন এমন বিশেষজ্ঞরা মশা তাড়ানোর কার্যকর উপায় হিসেবে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মশারি টাঙানোও মশা থেকে সুরক্ষিত থাকার উপায় হতে পারে।
মশা তাড়াতে কয়েল একটি অতিসাধারণ উপায় মনে হলেও, স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ও আগুনের বিপদ থেকে সুরক্ষিত থাকতে মশার কয়েল এড়িয়ে চলা আবশ্যক। নিজের ও পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি বিবেচনা করে হলেও মশা নিধনে আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজন।