রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থান পরবর্তী সময়ে শীতল কলহের রাজনীতির যেন আবার আভাস পাওয়া শুরু হলো। রাশিয়ায় তখন এমন একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠলো যেখানে পুতিন বিরোধী মন্তব্য, পুতিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা তার অবমাননা হয় এমন মন্তব্য একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য। কখনও সাংবাদিক আন্না পলিটকভস্কায়া, কখনও বিশ্বস্ত বন্ধু ও সমর সহকারী ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন, কখনও প্রধান বিরোধী দলনেতা অ্যালেক্সি নাভালনি সাক্ষী হয়েছেন নেতার রোষানলের। এসব মৃত্যু খুব সহিংসভাবে ঘটানো হয়েছে তা নয়। খুব কৌশলেই পুতিনের রাজনৈতিক পথচলার বহু কাঁটা সরে গিয়েছে দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা কিংবা স্বাভাবিক মৃত্যুর ছলে। যারাই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছেন তারাই এমন নানা সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে মারা গেছেন।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যে ব্যক্তিদের রুশ নেতার জন্য হুমকি বলে মনে করা হয়েছে, দ্রুত তাদের প্রভাব খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। তাদের কেউ কেউ রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হয়েছেন, কেউ হয়েছেন কারাবন্দি। বেশিরভাগ সময়েই পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়। তেমনি কিছু সন্দেহজনক মৃত্যুর ঘটনা উল্লিখিত হলো:
পুতিনের অধীনে রাশিয়ায় পুলিশি রাষ্ট্র সম্পর্কে একটি বই লিখেছিলেন সাংবাদিক আন্না পলিটকভস্কায়া। এর পরপরই ২০০৬ সালে মৃত্যুদণ্ডের ধাঁচে কন্ট্রাক্ট কিলারদের হাতে খুন হয়েছিলেন তিনি। মস্কোতে তার ফ্ল্যাটের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল পলিটকভস্কায়াকে। ঘটনাটি পশ্চিমা বিশ্বে তখন একটি ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। পুতিন ধীরে ধীরে মিডিয়া হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিষয়টিকে একটা সমঝোতার পর্যায়েও নিয়ে আসে। রাশিয়ায় রিপোর্টিংয়ের উপর সরকারের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ একরকম গণতন্ত্রেরই যেন মুখ বন্ধ করে দেয় তখন।
পলিটকভস্কায়া রাশিয়ায় বর্তমানে নিষিদ্ধ স্বাধীন অনুসন্ধানী ম্যাগাজিন নোভায়া গাজেতার জন্য তার বেশিরভাগ কাজ করেছেন। বারবার আটক হওয়া সত্ত্বেও চেচনিয়ায় রাশিয়ান ও মিত্র বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের দ্বারা সংঘটিত নির্যাতনের রিপোর্ট করার জন্য এক ডজনেরও বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন।
এরপর ২০১৪ সালে হত্যার দায়ে সাবেক আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা সের্গেই খাদজিকুরবানভকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। খাদঝিকুরবানভকে উত্তর ককেশাসের একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল চেচনিয়া থেকে আরও চারজন পুরুষসহ দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সেখানে রাশিয়া এবং তার স্থানীয় মিত্ররা পুতিনের অধীনে ১৯৯৪-১৯৯৬ এবং ১৯৯৯-২০০৯ সালে দুটি বিদ্রোহ দমন করেছিল। তারপর তাকে ক্ষমাও করে দেওয়া হয়েছিল।
২০১৮ সালে স্ট্রাসবার্গের ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত বলে, সরাসরি হত্যা চুক্তি চালিয়েছে এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য পর্যাপ্ত তদন্তমূলক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। অন্যদিকে একটি যৌথ বিবৃতিতে নোভায়া গেজেটা এবং পলিটকভস্কায়ার সন্তান ইলিয়া এবং ভেরা বলেছেন, ক্ষমা করে দেওয়া একটি ভয়ানক অবিচার এবং স্বেচ্ছাচারিতা ছিল। নিহত ব্যক্তির পেশাগত দায়িত্ব পালনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে এমনটি করা হয়েছে।

কেজিবির সাবেক এজেন্ট আলেকজান্ডার লিটভিনেনকোর ভাগ্যেও ছিল একই রকম পরিণতি। তিনিও ছিলেন পুতিনের সমালোচক। ২০০৬ সালে লন্ডনে মারা যান তিনি। এক কাপ চা পান করার তিন সপ্তাহ পরও যাতে মারাত্মক তেজস্ক্রিয় উপাদান পোলোনিয়াম-২১০ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
পক্ষ ত্যাগ করা রুশ গুপ্তচর আলেকজান্ডার লিটভিনেনকো প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিলেন, পুতিন একটি অপরাধ সিন্ডিকেটের মতো রাশিয়াকে চালাচ্ছেন। তাকে ২০০৬ সালে বিরল তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ তদন্তে দেখা গেছে, তিনি রাশিয়ান এজেন্টদের দ্বারা বিষ প্রয়োগের শিকার হয়েছিলেন যা ‘সম্ভবত’ পুতিনের আদেশে হয়েছিল। তবে রাশিয়ার সরকার এই মৃত্যুর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এতে জড়িত থাকার অভিযোগও অস্বীকার করেছে।

এ ধারার শুরুটা হয়েছিল রুশ নেতা পুতিনের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রথম দিকেই। তার উত্থানে ভূমিকা ছিল প্রভাবশালী বরিস বেরেজোভস্কির। পুতিনকে অপমান করায় তাকে পালাতে হয়েছিল। কয়েক বছর ধরে তাকে গণশত্রু হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরে ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যে তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পুতিনের আনুগত্য না করায় আরেক প্রভাবশালী মিখাইল খোদোরকোভস্কিকে এক দশকের বেশি সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
এক সময়ের রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সের্গেই স্ক্রিপাল যুক্তরাজ্যের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন (ডাবল এজেন্ট)। ২০১৮ সালে নার্ভ এজেন্ট (বিষাক্ত গ্যাস) প্রয়োগ করে তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। পরে তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘ঘৃণ্য’ বলে অভিহিত করেছিলেন পুতিন।
দেশটির সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেতা বরিস নেমতস্তভের পিঠে চারটি গুলি করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্রেমলিনের কাছে একটি সেতুর ওপর গাড়িতে থাকা একজন অজ্ঞাতপরিচয় হামলাকারী নেমতসভকে পেছন থেকে চারবার গুলি করে।
ইউক্রেনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে মস্কোতে একটি মিছিলে সমর্থনের আবেদন করার কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি মারা যান। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন। তদন্তকারীরা বলেছেন যে হত্যাকাণ্ডটি দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে একটি উসকানি হতে পারে। তদন্ত কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে যে হত্যাকাণ্ডের জন্য “ইসলামী চরমপন্থা” সহ বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য বিবেচনা করা হচ্ছে।

গণতন্ত্রপন্থী রাজনীতিক অ্যালেক্সি নাভালনি কারাগারেই ছিলেন। স্ক্রিপালকে যে নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছিল, ২০২০ সালে নাভালনিকেও একই ধরনের গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।
সম্প্রতি রাশিয়ার এই বিরোধী দলের নেতা ও পুতিনের কট্টর সমলোচক অ্যালেক্সি নাভালনির কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে চলছে নিন্দা ও ক্ষোভ ছড়িয়েছে।

রাশিয়ান সসেজ ম্যাগনেট এবং রাজনীতিবিদ দেশের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী আইন প্রণেতা পাভেল অন্তভ এর পরিণতিও ছিল ভয়াবহ। পাভেল অন্তভ ছিলেন পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির সদস্য। ২০২২ সালে ভারতের একটি হোটেলের জানালা থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের সমালোচনামূলক একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। এমন দাবি অস্বীকার করার পরেও রেহাই পাওয়া যায়নি। ঘটনার পরপরই তার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। একই সফরে থাকা আরেকজন ভ্লাদিমির বুদানভও তার হোটেলে মারা যান।
পাভেল আন্তভ ভ্লাদিমির পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির সদস্য এবং বহু-মিলিয়নিয়ার ছিলেন। তিনি রাশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম সসেজ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তার আসন্ন ৬৬ তম জন্মদিন উদযাপনের জন্য একটি ভ্রমণে ছিলেন। ভারতের সেই বিলাসবহুল হোটেলের তৃতীয় তলার জানালা থেকে পড়েই রহস্যজনক মৃত্যু হয় তার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা ভারতের এনডিটিভি নিউজকে বলেছেন, তারা সন্দেহ করেছে যে একই হোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া তার বন্ধুর মৃত্যুর বিষয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়েই তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন। আন্তোভ রাশিয়ার ভ্লাদিমির অঞ্চলের আইনসভার কৃষি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এবং দেশের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী আইন প্রণেতা হিসেবেও স্থান পেয়েছিলেন।
রাশিয়ার শীর্ষ তেল ব্যবসায়ীদের একজন ৬৭ বছর বয়সী রাভিল ম্যাগানভ। ইউক্রেনের যুদ্ধের সমালোচনা করার পর মস্কোর একটি হাসপাতালের জানালা থেকে পড়ে যান। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উত্পাদক লুকোইলের চেয়ারম্যান রাভিল ম্যাগানভ হাসপাতালের জানালা থেকে পড়েই মারা গিয়েছিলেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটি সূত্রের বরাত দিয়ে মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে জানিয়েছে। এটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে ম্যাগানভ হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং তিনি অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্টও গ্রহণ করেছেন। অবশ্য রয়টার্স সেসব তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। ম্যাগানভের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচিতির ভিত্তিতে তিনটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে যে, তারা বিশ্বাস করেনা যে সে আত্মহত্যা করেছে। তাছাড়া সে আত্মহত্যা করেছে এমন কোনো প্রমাণ বা নথিও দেখানো হয়নি।

ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন এর পরিণতিও তার ব্যতিক্রম নয়। পরম বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যাওয়া প্রিগোশিনের মৃত্যুতেও শোক প্রকাশ করেছেন পুতিন। শীতল মাথায় খেলেছেন রাজনৈতিক খেলা। সামরিকভাবে শক্তিশালী প্রিগোসিনের মৃত্যু হয় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায়।
রাশিয়ায় ২০২৩ এর জুনে অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেননি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তখন বিশ্বজুড়ে সমালোচকেরা বিষয়টিকে রুশ নেতার দৃশ্যত যুদ্ধকালীন দুর্বলতা হিসেবে দেখছিলেন। কেউ কেউ বলেছিলেন, সংক্ষিপ্ত এ অভ্যুত্থান পুতিন-পরবর্তী যুগের সূচনা করেছে। কিন্তু তার দুই মাস পরই নিজের ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন প্রিগোশিন। ২৩ আগস্ট মস্কো থেকে নিজের এলাকা সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার পথে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়ে খোলা মাঠে আছড়ে পড়ে। জনসমক্ষে পুতিন বলেছেন, ‘জীবনে অনেক ভুল করেছেন প্রিগোশিন।’

প্রিগোশিন বলেছিলেন, ভাগনার বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল মস্কোর সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাত, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে নয়। এরপরও এ বিদ্রোহকে ২৩ বছরের শাসন আমলে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখেছিল পুতিন। পরিণতি প্রিগোশিনের এমন সন্দেহভাজন মৃত্যু।