ভারতের ভূ-খন্ড ব্যবহার করে ভুটান নেপালসহ অন্যদেশে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানী সুবিধা ট্রান্সশিপমেন্ট হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশীদের মধ্যে। তবে কি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরো তলানীতে গিয়ে পৌঁছালো? এমন প্রশ্ন সবার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভুটান ও নেপালসহ অন্যদেশে বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানীতে কি ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়েও চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
ভারতের এই দাদাগিরি এবং মোদীগিরি কি হাসিনা আর ভারতের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ফল? ভারতকে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা যা দিয়েছে তা তারা সারাজীবন মনে রাখবে। এখন এসব সুবিধা না পেয়ে মোদী কি খেপাটে হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? চলুন দেখা যাক এর আধ্যপান্ত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পেছনে তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার যুক্তি তুলে ধরেছে। ভারত বলছে, এটি রাজনৈতিক কোনো বিষয় নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত।
এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তবে তার পরপরই ভারতের বিমানবন্দর এবং অন্যান্য বন্দরগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপক জট তৈরি হতে থাকে।
তিনি বলেন, এই কারণে সময়ের অপচয় বাড়ে, খরচ বেড়ে যায় এবং ভারতের রপ্তানি কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছিল। এর ফলে বন্দরে আটকে পড়া পণ্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাই, এই সমস্যাগুলোর সমাধানে ২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ভারতের তরফ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়, ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল হলেও বাংলাদেশের পণ্য নেপাল ও ভুটানে রপ্তানি আগের মতো অব্যাহত থাকবে। রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি প্রক্রিয়া একইভাবে চালু থাকবে এবং এতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস, সিবিআইসি একটি সার্কুলার জারি করে জানায় যে, ২০২০ সালের ২৯ জুনের পুরনো সার্কুলারটি অবিলম্বে বাতিল করা হবে। ওই সার্কুলারে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্য কনটেইনার বা কাভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে পাঠানোর জন্য ভারতের স্থল শুল্ক স্টেশন থেকে অন্যান্য বন্দর বা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়া হবে। তবে নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, এখন থেকে শুধুমাত্র ট্রানজিটে থাকা বাংলাদেশি পণ্য বিদ্যমান প্রক্রিয়া অনুযায়ী ভারত ছাড়তে পারবে, তবে নতুন পণ্যের চালান ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে না।
এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে এই পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে।
ট্রান্সশিপমেন্টে বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিক ও রপ্তানিকারকেরা বলেন, ভারতের এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সাময়িক কিছুটা চাপে পড়বেন। কারণ, আমাদের বিমানবন্দরের সক্ষমতা কম। এখন আমাদের বিকল্প ট্রান্সশিপমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে, এ সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের চেয়ে ভারতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং, সানেম এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, এ সিদ্ধান্ত তৈরি পোশাক শিল্পের মতো খাতে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। তবে এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক সংক্রান্ত বৃহত্তর ইস্যুটিকে তুলে ধরেছে। এ ধরনের পদক্ষেপ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ডব্লিউটিও এর নীতিমালার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তিনি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতি যত জটিল ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এখন আগের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং বাণিজ্যের সুষ্ঠু প্রবাহ বজায় রাখা উভয় পক্ষের জন্যই অত্যন্ত জরুরি। ভারত বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে অন্যতম এবং নীতিগত এ পরিবর্তন ভবিষ্যতের উন্নত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সম্ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা আশা করি ভারত তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে এবং উভয় দেশের জন্য উপকারী সমাধান খুঁজে বের করতে সংলাপে বসবে বলে আশা করেন সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন এবং এ ধরনের সিদ্ধান্ত দুই দেশের যৌথ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাফা’র সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে এটি কিছুটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, আমাদের অতিরিক্ত কার্গো আগে ভারতীয় বিমানবন্দরগুলো দিয়ে যেত। এখন কোন দেশ থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নেওয়া যায় তা বের করতে হবে। প্রয়োজনে আমরা শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের বিমানবন্দরগুলো ব্যবহার করব।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাণিজ্যে পোশাক খাতে ভারতের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ। ভারতীয় রপ্তানিকারকদের সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশন, এফআইইও এর মহাপরিচালক অজয় সাহাই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করা প্রসঙ্গে বলেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে এখন আমাদের কার্গো পরিবহনে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকবে। অতীতে রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার কারণে বন্দর ও বিমানবন্দরে স্থান কম পাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করতেন।
এর আগে, ভারতের পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন এইপিসি বাংলাদেশকে দেওয়া সুবিধা স্থগিত করার আহ্বান জানায়। এইপিসির চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি এ বলেন, প্রত্যেক দিন গড়ে প্রায় ২০ থেকে ৩০টি পণ্যবাহী ট্রাক দিল্লিতে আসতো। যা কার্গোর চলাচল ধীর করে দিতো এবং এয়ারলাইন্সগুলো এ ধীরগতির কারণে অযৌক্তিক সুবিধা আদায় করতো।
ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ, জিটিআরআই এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তবের মতে, এ সুবিধা প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রম ব্যাহত হবে। যদিও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, ডব্লিউটিও এর বিধি অনুযায়ী, স্থলবেষ্টিত দেশগুলো এবং সেসব দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্যের অবাধ পরিবহনের অনুমতি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে সংস্থাটির সব সদস্যের। এর অর্থ এ জাতীয় ট্রানজিট অবশ্যই বাধাহীন হতে হবে এবং এসব পণ্য অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব ও ট্রানজিট শুল্কমুক্ত থাকবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো ও অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের সিদ্ধান্তটা বেশ অপ্রত্যাশিতই বলা চলে। তবে আমরা এই সুবিধাটা খুব যে বেশি ব্যবহার করতাম তা না। ফলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের ফলে আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে কিছু পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাবান্ধা দিয়ে নেপালে প্রায় তিন হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
এর আগে ভারতীয় সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট অ্যান্ড কাস্টমস, সিবিআইসি বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের নোটিশ জারি করে। ২০২০ সালে, ভারত সরকার বাংলাদেশকে তার বন্দরের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানি করার জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করেছিল। ভারতের রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশকে দেওয়া এই সুবিধা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, বিশেষ করে পোশাক খাতের রপ্তানি নিয়ে। তাদের এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধ করে দেয়া হলো ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা। ভারতের এই সিদ্ধান্তের কি প্রভাব পড়ে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে তা দেখার জন্যে এখন শুধুই অপেক্ষা।
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)