বিদায়ের বিউগলে উদাসের গান

বিদায়ের বিউগলে উদাসের গান

বিদায়ের বিউগলে উদাসের গান

আল মাহফুজ

‘চোখ তার চোরাবালি, মন যে পাথর
চোখ তার চোরাবালি, মন যে পাথর
কবরের ওপরেতে যেন বাঁধা ঘর
ভালোবাসা যাকে করে গেছে পর..’

এলায়িত মোলায়েম কণ্ঠে এই গান গেয়েছিলেন পঙ্কজ উদাস। কি দরদ মাখা সেই সুর। শ্রোতারা যেন সুরের তরীতে ভেসে যেতো দূর কোন দ্বীপে। যে দ্বীপে ব্যথার গান বাজে মহুয়া ফুলের সৌরভে। যে দ্বীপের পিয়াল বনে ডাহুক ডাকে না। স্তব্ধ রাত, স্তব্ধ জনপদ। এ কি অনিন্দ্য বিভ্রান্তি!

শিল্প কি শিল্পীকে ছাপিয়ে মহাকাল ছুঁতে পারে? হয়তো পারে, হয়তো নয়। তবে এই গান, এমন অনেক দর্পচূর্ণ গান আজ নিশ্চয়ই পঙ্কজের বিদায়ে ‘উদাস’ হয়েছে। আজ নিশ্চয়ই সারগামের সব সুর বিদায়ের বিউগলে স্মরণ করছে গজল সম্রাটকে। সম্রাটের বিদায় তো জমকালো হতেই হবে!

পঙ্কজ উদাস ভারতের গুজরাটে জন্মগ্রহণ করেন। মূলত গজল গায়ক হিসেবে মানুষের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই তার। ১৯৮০ সালে ‘আহত’ শিরোনামের গজল অ্যালবাম প্রকাশের মধ্য দিয়ে সংগীত দুনিয়ায় প্রবেশ করেন তিনি।

৪০ বছরেরও বেশি সময় বলিউড মাতিয়েছেন ভারতীয় এই গজলশিল্পী। হিন্দি ছবির গানে দশকের পর দশক মুগ্ধ করেছেন দর্শক-শ্রোতাকে। ‘দিওয়ারো সে মিল কর রোনা’, ‘চান্দি জ্যায়সা রং’, ‘আহিস্তা’, থোড়ি থোরি পিয়া কারো’, ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়‘, ‘না কাজরে কি ধার’, ‘নিকলো না বেনাকাব’– পঙ্কজ উদাসের গাওয়া অনবদ্য এসব গজল শুধু দশক থেকে দশকে নয়, এক শতক থেকে আরেক শতকেও হয়তো রয়ে যাবে। ‘জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে বিন আপকে’, ‘অউর আহিস্তা কি জে বাতে’ এসব ঝঙ্কার তোলা উদাস করা গান নিশ্চয়ই রঙ ছড়াবে শ্রোতামনে, বহু বছর পরও।

সুরের ডালি নিয়ে হাজির পঙ্কজ উদাস। ছবি:এএনআই

‘নশা’, ‘হসরত’, ‘পয়মানা’, ‘হামসফর’-এর মতো বেশ কয়েকটি কালজয়ী অ্যালবামও রয়েছে। যেগুলো সবসময় হয়েছে শ্রোতাদের মনের রসদ। বুকের ভেতরটা ঠিক ভেঙ্গে পড়ছে কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতে চাচ্ছেন না। আপনি পঙ্কজ শুনুন। পঙ্কজের গান মোক্ষম জায়গায় আঘাত করবে। বিমর্ষতায় দিক্বিদিক হয়ে পড়ছেন, কান্নার রঙ ঝরাতে চাচ্ছেন কিন্তু ঝরছে না কিছুতেই। পঙ্কজ উদাস শুনুন। আপনি কাঁদবেন, সুরের আর্দ্রতায় মন হবে শান্ত। কল্পনাতীত এক জগতে ভেসে যেতে হবে। এরপর আপনার মাঝে জাগরিত হবে পরম শান্তির। গজলের মূর্ছনায় মনে হবে, আপনি একজন সন্ত কবীর। এভাবেই পঙ্কজের গান হয়ে ওঠে চিরন্তন!

বাংলা ভাষায় পঙ্কজ গেয়েছেন ‘চোখ তার চোরাবালি’, ‘আমি তাকে ভালোবাসি এখনও’, ‘বন্ধু ভাবতে পারো আমায়’, ‘গোলাপ ঠোঁটে রঙিন হাসি’, ‘তোমার চোখেতে ধরা’, ‘চোখে চোখ রেখে’ ইত্যাদি অসংখ্য জনপ্রিয় গান। তবে পঙ্কজ উদাসকে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে মাপা অন্যায়। তার গজল, তার গাওয়া গান এমন এক উপলব্ধি দেয়, যেটা বারবার পেতে মনে চায়। কখনও কখনও মনে হয়, ঐন্দ্রজালিক নেশাতুর। মনে হয়, রিনরিনে এই কণ্ঠ যেকোনো গানকেই করে তুলতে পারে ‘ডিভাইন’। স্বর্গ থেকে নাজিল হওয়া কিছু যেন। স্বর্গে ‘উদাস’ নয়, শাশ্বত শিল্পী হয়ে থাকবেন পঙ্কজ..

ভালোবাসার কোনো সীমানা নেই, নেই কোনো ভাষা। তেমনি সংগীত সুধা পানেরও কোনো সীমা নেই। প্রবাসের সঙ্গে দেশের সংযোগের মাধ্যম ছিল ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়‘ গানটি। দেশের জন্য মন খারাপ হলে তার গাওয়া এই গান প্রিয়জনদের সঙ্গে বন্ধনসূত্র তৈরি করে দিতো প্রবাসের মানুষগুলোকে। আজ থেকে এই গানের বন্ধনসূত্র পার্থিব জগতের শ্রোতার সঙ্গে স্বর্গীয় গজল সম্রাটের। আমাদের মন খারাপ হলে চিঠি লিখব। চিঠি পাওয়ামাত্র সুরের ডালি নিয়ে হাজির হবেন পঙ্কজ।

‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়।
বতনসে চিঠঠি আয়ি হ্যায়।
বড়ে দিনো কে বাদ হম বেওয়াতনকো ইয়াদ।
ওয়াতন কি মিট্টি আয়ি হ্যায়।’

Scroll to Top