সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকলেও, ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিচারিক কর্মকর্তাকে নয়; বরং নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদেরই নিয়োগ দেওয়ার বিধান বহাল রাখা হয়। এভাবে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে বিচার বিভাগে পরোক্ষভাবে আংশিক দ্বৈত শাসনব্যবস্থাই চালু রাখা হয়।
কিন্তু এই জোড়াতালির বন্দোবস্তও বেশি দিন সহ্য করেননি রাজনীতিবিদেরা। সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এক বিন্দুতে ঘনীভূত করতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রিম কোর্ট’–এর জায়গায় ‘রাষ্ট্রপতি’ লিখে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটদের তো বটেই, তার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণও নিজের হাতে তুলে নেয় সরকার।
একটিমাত্র শব্দ বদলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বলা যায়, যবনিকাপাত ঘটে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা পৃথক্করণ নিশ্চিত করার যাবতীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রথম অধ্যায়ের। এভাবে পৃথক্করণের বদলে একীভূতকরণই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নীতি।
এই সংশোধনী দিয়ে কার্যত সংবিধান ‘পুনর্লিখন’ করে তার মাধ্যমে কায়েম করা একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা বেশি দিন টেকেনি। পরবর্তী আমলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আরেক দফায় সংবিধানের পুনর্লিখন করা হয়। এই সরকারের আমলে অবশ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার্থে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে নিয়ে দেশের শীর্ষ তিন বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত করা হয়।
১১৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই রাষ্ট্রপতি বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ করবেন, এমন রক্ষাকবচও জুড়ে দেওয়ার কাজটি করে কিছুটা ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সংবিধানে আরও যোগ করা হয়, অধস্তন আদালতের বিচারক ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক কাজে স্বাধীন থাকার নিশ্চয়তা দেওয়া সংবলিত ১১৬ক অনুচ্ছেদ। পঞ্চম সংশোধনীর আওতায় চতুর্থ সংশোধনীর বেশির ভাগ বাতিল হয়ে গেলেও ১১৬ অনুচ্ছেদের ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি কিন্তু ঠিকই টিকে যায়।
১৯৮২ সালে ঘটা এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ প্রবেশ করে আরেক জমানায়। আশ্চর্যরকমভাবে তৎকালীন সামরিক শাসক রাষ্ট্রের বিচারিক সেবা জনগণের দোরগোড়ায় নেওয়ার নীতি নিয়েছিলেন। আঞ্চলিক পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন ও উপজেলাগুলোতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিচার বিভাগ পৃথকীক্রণের উদ্যোগ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের খসড়াও প্রস্তুত করে ফেলা হয়েছিল।
কিন্তু সেগুলো আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই আগের ধারাই বহাল থাকে। পরে আদালতের রায়ে উচ্চ আদালত এবং তারও পরে নির্বাহী আদেশে অধস্তন আদালতের বিকেন্দ্রীকরণের উভয় প্রকল্পই বাতিল হয়ে যায়।
১৯৯০ সালে আরেকটি গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তৃতীয় দফায় ঘটে সংবিধান ‘পুনর্লিখন’। রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির বদলে দেশ প্রবেশ করে সংসদীয় পদ্ধতিতে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। ২০০৭–এর আগে পালাক্রমে রাজনৈতিক সরকার এল-গেল, কিন্তু বিচার বিভাগ একত্রীকরণের নীতির আর বদল হয়নি।
এর মধ্যে মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগের পৃথক্করণের সাংবিধানিক পর্যালোচনা করতে গিয়েও আদালত ‘আবিষ্কার’ করেন যে ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে একটি অনতিক্রম্য দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তাই আদালত সংবিধানের অন্য বিধানাবলির চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই দ্বৈতশাসনের মধ্যেই যতটুকু পৃথক্করণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেটুকু বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেন।
পূর্ণাঙ্গ পৃথক্করণ নিশ্চিতের জন্য সংবিধান সংশোধনের জন্য আবশ্যকতা স্বীকার করা হয়েছে আদালতের ১২ দফা নির্দেশনাতেই। নির্দেশনার ১১তম দফায় বলা হয়েছে, ‘অধস্তন বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য আর কোনো সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই মর্মে হাইকোর্ট বিভাগের ঘোষণাটি রদ ও রহিত করা হলো। জাতীয় সংসদ চাইলে এ স্বাতন্ত্রীকরণকে আরও অর্থবহ, সুস্পষ্ট, কার্যকর ও সম্পূর্ণ করতে সংবিধান সংশোধন করতে পারেন।’
বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্রীকরণকে সম্পূর্ণ করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে আইনসভা, অর্থাৎ সংসদকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি কখনো। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে যখন চতুর্থ দফায় সংবিধান পুনর্লিখন করতে দেখা যায়, তখনো জাতীয় সংসদ এই প্রশ্নে পঞ্চম সংশোধনীকেই বহাল রাখেন। পরিহাস হলো, আদালতের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার অজুহাত দেখিয়েই পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়েছিল।