টরন্টো, ২৫ ফেব্রুয়ারী – আহা , আজে এ বসন্তে, যখন প্রবাসের প্রকৃতিতে শীতকাল। কানাডায় প্রায় একশ বিশ হাজার প্রবাসী বাংগালীদের মধ্যে সম্মানীয় শক্ত আসন গেড়েছেন বেশ কয়েকজন বাংগালী!
অনেকে এর মধ্যেই সানশাইন লিস্টে জায়গা করে নিয়েছেন আবার কেউ কেউ নিজেকে হাই স্পিডে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কেনেডিয়ানদের সাথে ভিন্ন ভিন্ন পদে প্রতিযেগীতা করে ।
শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয় , সাংস্কৃতিক অঙ্গনে,সংবাদপত্র, মিডিয়া , টেলিভিশন, রেডিওতেও বাংলাদেশী কমিউনিটি যথেস্ট ছাপ রেখে যাচ্ছে নিজেদের উজ্জ্বল বৈশিস্ট্যে ।
বসন্ত বাতাসে সই লো…
ফেইসবুকে বিকশিত একটি ফুড গ্রুপের চেতনা থেকে শুরু হয় বিভিন্ন থীমে নানানভাবে দেশীয় উৎসব যাপন । কখনো ভার্চুয়্যাল বৈশীখ, কখনো পিকনিক ছলে ঝালমুড়ি আড্ডা আর এবারের আলোড়ন রবীন্দ্রনাথ থীমে ফাল্গুন ।
এই গ্রুপটিতে সদস্যের সংখ্যা প্রায় নয় হাজারে ছুঁই ছুঁই । সকলকে এক করা অসম্ভব , তারপরও সাহস করে প্রায় সাড়ে তিনশ জনের জন্য ফাল্গুন উদযাপনের বন্দোবস্ত করা হোল ~ রবীঠাকুরের আবহে, স্কারবোরর একটি হলে ।
সেদিন সন্ধ্যায় যেন জোড়াসাঁকোর লাল দালানের সামনে ইংরেজী ১৯০০ সালের কোনো এক ফাল্গুনী মেলা বসেছিল । বাংলা পন্জিকায় আসলে ১৪২৯ এর ফাল্গুন নিয়ে যত গুন্জন।
বিশাল হলের এক পাশে স্টেজ সাজানো হোলো, কুঠিবাড়ির লাল দালানের ব্যাকড্রপ দিয়ে – তিনপিসে করা বিশাল বাড়ির নিঁখুত চিত্র । লাল আলোর প্রতিফলনে পুরোনো আমলের আধো-অন্ধকার পরিবেশ। মাঝে গোল টেবিলে চেয়ার পাতা হোলো, নক্শিকাঁথার প্রিন্টের টেবিল ম্যাট প্রতিজনের জন্য তাতে ছোট বাটি, সেই বাটিতে একটি করে গেন্দা ফুল । আহা আজি এ বসন্তে , কত ফুল …সারা হলের প্রতিটি টেবিলে।
একপাশে একটি টেবিলে সাজানো হোল অতিথীদের নিজ হাতে তৈরী করে আনা একেকটি খাবার , অনুষ্ঠানের শেষে বিচারকের রায়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের ঘোষনার জন্য ।
হলের অপর প্রান্তে ছিল বিশেষ আকর্ষন ~ ফটো বুথ । রবীন্দ্র থীমের সব কয়টি ফটোবুথ সম্পূর্নই সে আমলের সাথে মিল রেখে তৈরী করা।
বারান্দার সামনে দুটো কুঠিবাড়ির দরজা, হাতল ওয়ালা রোমিও-জুলিয়েট চেয়ার , কুরুশ-লেইসের পাতলা পর্দা একপাশে টানা , পিছনে কাঁচের শার্সি দিয়ে প্রবাসের রূক্ষ শীতকাল,মাঝে পুরোনো ধাঁচের কাঠের গোল টেবিলের উপর রবীন্দ্র নাথের ছবি আর সেই ছবির ফুলদানী , কুরুশ-উল-এম্ব্রয়ডারী প্রপ.. একেকজনের তোলা প্রতিটি ছবি এমন এসেছে যেন তারা ঠাকুরবাড়ির বারান্দায় বসা।
একটি অন্যরকম পালকি ছিল । নার্গিসের শখে একটু অন্যরকম পাল্কী .. এরকমই বলে সবসময় মেয়েটা। একটু অন্যরকম । সনাতন রংগীন পাল্কীর বদলে নক্সী কাঁথার ছবি হবে পাল্কীর গায়ে । পিছনে লাল নক্সী কাঁথা আর পাল্কীর গায়ে ঘিয়ে রংয়ের নক্সীকাঁথার আঁচড়ে সেটা ছিল অনুপম এক ফটোবুথ ।নারীদের কেউই বোধকরি বাদ রাখেননি নিজেকে জোড়াসাঁকোর পাল্কিতে বসে একটি লাজুক বধুর ছবি তুলতে ।
একপাশে রবীঠাকুর স্বয়ং দন্ডায়মান ছিলেন সকলকে যাচাই করতে । সেই ফটোবুথে একটি রূপালী ভিন্টেজ ফোন ছিল চৌকো কর্নার টেবিলের উপর , কাঠের হাতল ওয়ালা চেয়ার ছোট টুল , কবির একটি বই, একটি ল্যাম্প .. আর সকল অতিথী ! কোনো কোনো ছবিতে মেয়েদের পিছন থেকে যেন রবীঠাকুর ফটোবাম হচ্ছিলেন – এতটাই জীবন্ত ছিল তার সবুজ আলখাল্লা পড়া পোস্টারটি ।
একটি ফটোবুথ ছিল যেন ,আস্তর খসে পড়া দেয়ালের সামনে মৃদু আলোমাখা কাঠের বেড়া দেয়া বারান্দা । সেখানে পাতা ছিল কাঠের টুল, খোলা ছিল একটি জানালা, কয়েকটা ঝোলানো ল্যাম্প … আর আস্তর খসে পড়া দেয়ালের গায়ে লিখা “রং যেন মোর মর্মে লাগে” !
অপূর্ব এক আবহ ।
এবারে আসি অতিথী আর আয়েজকদের পোশাক নির্বাচনে। ফুড গ্রুপের আয়েজনে আগে থেকেই রং এর শেড জানিয়ে দেয়া হয়ে ছিল , বলা হয়েছিল জামদানী-মসলিন-তাঁত-সিল্ক আর দেশী কাপড়ে রবীন্দ্র নাথের পরিবার কিম্বা গল্পের কোনো চরিত্রে সেজে আসতে । বেনী, খোঁপা, বেলী, গেন্দা, ফ্রীল দেয়া ব্লাউজের হাতা, আঁচলে চাবীর গোছা, কোমরের বিছা, মাথায় টিকলি, হাতে বাজুবন্দে সেদিন বিকেলে লাস্যময়ী ছিল মৃনালিনী, কাদম্বরী, জ্ঞানদানন্দিনী, হৈমন্তী,নিরুপমা, বিন্দু আরো অনেকে ।
অন্যদিকে ছিল রবীন্দ্র বেশে তরুন যুবক প্রৌঢ় পুরষেরা – ধ্যুতি,পাজামা, আংরাক্ষা, জোব্বা, কালো আচকান, নানা স্টাইলে পড়া শাল, নাগড়া আর টুপির আভরনে বেশ রোম্যানিটিক মুডে বিচরন করছিলেন ।শিশু কিশেররাও বাদ পড়েনি এই মোহ থেকে । চারিদিকে বসন্ত আর রবীন্দ্রনাথের নায়ক নায়িকাদের কলরবে পরিবেশন করা হোল ঠাকুরের প্রিয় পাকোড়া, জিলেপী, লুচি , আলুর দম, সাদা ভাত , পোলাও, বেগুন ভাজি , মুরগী আলুর ঝোল , টমেটোর খাট্টা, গুড়ের চা, পায়েশ আরো কত কি !
আনন্দলোকে মংগলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর ~
সত্যিই সুন্দর করে পরিবেশন হোল সদস্যের অংশগ্রহনের রবীন্দ্র সংগীত, কবির অনুরাগ মাখা কবিতা আবৃতি, দলীয় সংগীত , ফ্যাশন শো, বেস্ট আউটফিট কন্টেস্ট, বেস্ট খাবারের কন্টেস্ট … জীবনকে সর্বোচ্চ আনন্দে উপভোগ করার কন্টেস্ট ।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে ~ দেশ, বসন্ত আর প্রেম । রবীঠাকুর লিখেছিলেন বোধহয় আমাদের এযুগের কথা ভেবেই।
এখন শীতকাল , এই প্রবাসে । একশ বিশ হাজার প্রবাসী বাংগালীদের মধ্যে সাড়ে তিনশ বাংগালী কেনাডার মাটিতে বসল্ত পালন করেছিল সেদিন চরম আনন্দে ।
ফুল ফুটুক আর না ফুটুক ~ সেদিন বসন্ত ছিল বাংলাদেশ ফুড লাভার্স অফ কেনাডার আয়েজিত ফাল্গুন অনুস্ঠানে ।
বাংলাদেশী ফুড লাভারস ইন কানাডা- ফুড গ্রুপের উদ্যোক্তারা তাদের অসম্ভব গুনী টীম নিয়ে এই ফাল্গুন অনুষ্ঠানটি সফল করার জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন , পরিচিত-অপরিচিত সকল অতিথীদের বিপুল ছবি-ক্র্যাশে তার প্রমান স্বরূপ ছাপ রেখে গেছে ।
সেদিন – ২ ফাল্গুন, ১৩০২ বাংলা সালে তিনি রচনা করেছিলেন ..
আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
রবীঠাকুরকে কেতাদুরস্ত স্টাইল অনুসরন করে এই ফাল্গুনে শাল, কোট, আলখাল্লা, আংরাক্ষা পান্জাবী, ভেস্ট ইত্যাদির মধ্য থেকে একেকটি পরিধান করে একটু অন্যরকম কাব্যিক ভাব এসেছিল পুরুষদের মাঝে।
কবি আরো লিখেছিলেন :
তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে
ভেবে দেখুন মনে মনে ~ সেদিনের আসরে কতটা ফ্যাশনেবল লেগেছিল সকলকে কবির যুগের পোশাকে বসন্তমেলায় , কুঠিবাড়ির চত্বরে ॥
লেখাঃ শাকেরা হামিদ রহমান
আলোকচিত্রঃ কামরান মহসিন আলি